সমতলের আদিবাসীদের বর্ষবরণ

মাহবুব আলম

বাঙালি ও পাহাড়ি আদিবাসীদের মতো সমতলে বসবাসকারী আদিবাসীরাও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করে। এই বর্ষবরণে সমতলের বিভিন্ন আদিবাসী সাঁওতাল, মাহাতো, ওঁরাও, ভুনজার, মুন্ডাদের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য নেই। ওরা সবাই একই সঙ্গে বর্ষ বিদায় ও নববর্ষকে বরণ করে। ফলে এদের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ন্যূনতম তিন দিনের। এই আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র সাঁওতালদের বর্ষ শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। তাই সাঁওতালরা ফাল্গুন মাসে মহাধুমধাম করে বর্ষবরণ করে। তবে এরা বৈশাখ মাসেও উৎসব করে বৈশাখী উৎসব। অবশ্য, তা ওদের এক ভিন্ন উৎসব। এছাড়া সমতলে অন্যান্য প্রায় সকল আদিবাসী ১লা বৈশাখে নববর্ষ পালন ও বর্ষবরণ করে। একই সঙ্গে চৈত্রের শেষ দিনকে তারা পূজা-অর্চনা আর আনন্দ উৎসব করে বর্ষ বিদায় করে।

পহেলা বৈশাখে সমতলের যে সকল আদিবাসী বর্ষবরণ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মাহাতো, ওঁরাও, ভুনজার, মন্ডা, পাহান, শিং, তেলী, তুরি ও মুরুরি। ওঁরাও, ভুনজার, মন্ডা, পাহান, মাহাতো ও তুরি আদিবাসীরা চৈত্রের শেষ দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পুরাতন বর্ষকে বিদায় দেওয়ার জন্য পূজা-অর্চনা করে। এই পূজার সময় প্রায় সকল সম্প্রদায়ের নারীরা তুলসী গাছের পাশে মাটিতে সিঁদুরের ফোঁটা দেয়। সেই সাথে পূজার জন্য প্রস্তুত বেদিতে ফুল ছিটিয়ে দেয়। এই ফুল হচ্ছে শাল, শিমুল, শাপলা, মহুয়া ও চম্পা। সেই সাথে প্রস্তুতি চলে সন্ধ্যায় নাচ-গান আর হাঁড়িয়া পানের। এদিন ভুনজার, ওঁরাও ও মাহাতো নারীরা সারাদিন উপোস করে। তবে উপোসের আগের এরা লবণ ছাড়া আতপ চালের ভাত খায়। এর মাহাত্ম্য অবশ্য জানা যায়নি। তবে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুযায়ী নারীরা এভাবে সারাদিন উপোস করে। সেই সাথে সন্ধ্যা ও রাতে উৎসবের জন্য তেলের পিঠা তৈরি করে। সন্ধ্যায় যে পূজা দেয় তাকে এরা বলে বাসন্তী পূজা। চৈত্রের শেষ দিনের এই পূজাকে ওরা চৈতবিসিয়াও বলে।

১লা বৈশাখ নববর্ষের প্রথম দিন মুন্ডা, মাহাতো, ওঁরাওসহ প্রায় সকল আদিবাসী সকালে কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খায়। পান্তা খেয়ে পুরুষরা দলবদ্ধ হয়ে বের হয় শিকারের উদ্দেশ্যে। আর নারীরা নানান পদে রান্নার করে দুপুর ও সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য। দুপুরে কোনো কোনো আদিবাসী ৭ পদের রান্না করে। আবার কোনো কোনো আদিবাসী ১২ পদের রান্না করে। পান্তা নিয়ে ওদের মধ্যে বিশ্বাস সকালে পান্তা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও ওরা কষ্ট পাবে না। আর পান্তা খেয়ে শিকারে যাওয়ার আগে প্রত্যেক পুরুষ তীর ধনুক পূজা করে ঘর থেকে বের হয়। এবং সন্ধ্যার আগে যে শিকার নিয়ে আসে তা তারা দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। সেটা লাল মোরগ থেকে যে কোনো পশু হতে পারে। তারপর তারা দলবদ্ধ হয়ে খিচুড়ি রান্না করে খায়। খিচুড়ির চাল সংগ্রহ করে নারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে। অর্থাৎ এই প্রস্তুতি ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিকভাবে। সর্বাগ্রে এই খিচুড়ি উৎসর্গ করা হয় ভক্তি ভরে ঠাকুরকে। এ সময় ঠাকুরকে নারীরা পা ধুয়ে দেয়। এমনকি ঠাকুর যে বাড়ির উঠান দিয়ে যান সেই বাড়ির নারীরা ঠাকুরের পা ধৌত করে দেয়। তারপর সন্ধ্যায় শুরু হয় খ্যামটা আর ঝুমুর নাচ। এখন অবধি যা আদি ও অকৃত্রিম আছে। বাঙালিদের মতো ওদের সংস্কৃতিতে এখনো পাশ্চত্যে আগ্রাসন বা অন্যকিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তাইতো ওরা রঙিন পোশাকে নিজেদের রঙিন করে তোলে ঢাক ঢোলের বাদ্য বাজনায়।

মুন্ডাদের মধ্যে আবার এক অদ্ভুত রেওয়াজ আছে। তাহলো গায়ে কাদা ও রঙ মাখা। ওদের রীতি হলো ওইদিন বা উৎসবের দিনগুলোতে কোনো পুরুষকে কাদা ও রঙ মাখা দেখা গেলে তাকে মন ভরে হাঁড়িয়া খাওয়াতে হবে। ওদের বিশ্বাস এতে করে পরস্পরিক বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক জোরদার হয়।

মুন্ডা ও পাহানরা নববর্ষে ১২ পদের তরকারি রান্না করে। এ সময় অর্থাৎ উৎসবের সময় সকল প্রকার মাছ-মাংস বর্জন করে সকলেই নিরামিষভোজী হয়ে যায়। এ সময় তারা ফুল দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি সজ্জিত করে।

অবশ্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে সাঁওতালরা। সাঁওতালরা বৈশাখি উৎসবে ফুল দিয়ে তাদের পুরো বাড়ি সাজিয়ে তোলে। সেই সঙ্গে সাঁওতাল নারীরাও নিজেদের ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলে। বৈশাখ উদ্্যাপন উপলক্ষ্যে সাঁওতাল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কালাইয়ের ছাতু ও গুড় খায়। সেই ছাতু ও গুড় দিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের আপ্যায়ন করে। সেইসাথে রাতে নাচ গানে মত্ত হয়ে ফুর্তি করে। অবশ্য এই এর প্রধান উপকরণ হাঁড়িয়া। ঘরে তৈরি দেশি মদ। যা ভাত দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়াও মহুয়া ফুল থেকে তৈরি মহুয়ার শরবত পান এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর নির্বিশেষে এই মহুয়ার শরবত পান করে।

এখানে বলার দরকার সমতলে আদিবাসীদের একটা বড় অংশের ধর্ম হিন্দু হলেও অনেকে ধর্ম লোকধর্ম। অনেকেই সূর্য পূজা করে। কেউবা প্রকৃতির পূজারী। তবে খুব নগণ্য সংখ্যক আছে মুসলিম ধর্মের। এরা মূলত দেশের উত্তারঞ্চলে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে বসবাস করে।

সমতলের আদিবাসী তাদের উৎসবের তৃতীয় দিনের অর্থাৎ বর্ষবরণের তৃতীয় দিনে কম বেশি সকলেই পানি ছিটিয়ে উৎসব করে। ঠিক যেমনটি করে পাহাড়ের আদিবাসীরা। এক কথায় পাহাড়ের আদিবাসীদের মতো সমতল আদিবাসীদের বর্ষবরণও একটি ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসব। যা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কোনোরকম ভেজাল মুক্তভাবে। এদের উৎসবের এই ভেজাল মুক্তিই ওদের সংস্কৃতির শক্তি বই অন্যকিছু নয়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × one =