বডি কেয়ার

নীলাঞ্জনা নীলা

ত্বকের যত্নে কেবল মুখের যত্নটাই ভালোভাবে নেওয়া হয়। আমরা বডি বা শরীরের ত্বক নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত নই। দীর্ঘ সময় শরীরের ত্বকের যত্ন না নিলে সেখানে দেখা দিতে পারেন নানা ধরনের সমস্যা। মুখের ত্বকের থেকে শরীরের ত্বকের ধরন ভিন্ন হয় তাই মুখের যত্নের জন্য যা আমরা ব্যবহার করতে পারি শরীরের ত্বকের জন্য আমরা তা ব্যবহার করতে পারি না। তাই শরীরের ত্বকের দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমস্যা দেখা দেওয়ার আগে অবশ্যই যত্ন নেওয়া জরুরি। জেনে নেওয়া যাক কেমন করে আমরা নিতে পারি শরীরের ত্বকের যত্ন।

শরীরের ত্বক পোশাক দিয়ে ঢাকা থাকে বলে আমরা অনেক সময় অবহেলা করি। মনে করি সহজে মানুষের চোখে পড়বে না। কিন্তু অনেক সময় ঘাড়, পিঠ পোশাকের ফাঁকেও চোখে পড়ে। যা অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করে যদি সেখানে কালো ছোপ দাগ থাকে। শরীরের দাগের জন্য অনেকে ইচ্ছে মতো পোষাকও পরতে পারেন না। তাই আমরা যেভাবে মুখের যত্ন নিয়ে থাকি ঠিক সেভাবেই শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ত্বকের যত্ন নিতে হবে।

আমরা শরীরের ত্বকের যত্ন নেওয়া শুরু করতে পারি রান্নাঘরে থাকা বিভিন্ন উপাদান দিয়ে। চাইলে খুব সহজে ঘরোয়া পদ্ধতিতেও নিজের ত্বকের যত্ন নেওয়া সম্ভব। অনেকেই বডি কেয়ার এড়িয়ে যান, তারা মনে করেন প্রসাধনের প্রচুর দাম। কিন্তু পদ্ধতি জানা থাকলে ঘরের উপাদান দিয়েই ত্বকের যত্ন নেওয়া যায়। যেমন অনেক সময় হাতে ও পায়ে সানবার্ন হয়ে কালো দাগ পড়ে যায়। কারণ আমরা মুখে সানস্ক্রিন এপ্লাই করলেও হাতে ও পায়ে সাধারণত সানস্ক্রিন এপ্লাই করি না। এতে সরাসরি সূর্যের আলোতে হাত ও পায়ের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকের ঘাড়ে দেখা যায় কালো দাগ। সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা, হরমোনাল কারণ, ওজন বৃদ্ধি বিভিন্ন কারণে ঘাড়ে কালো দাগ হতে পারে।

শরীরের সবচেয়ে অবহেলিত স্থান বলা পিঠকে। কারণ পিঠ আমরা সরাসরি দেখতে পাই না এবং এখানে যত্ন নেওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য। দেখা যায় যত্নের অভাবের পিঠে ব্রণ, ফাঙ্গাল ইনফেকশন বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ঘাড়ে যদি কালো দাগ থাকে সেক্ষেত্রে বেসন লেবুর রস মিশিয়ে ঘাড়ে ত্রিশ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। এতে ধীরে ধীরে কালো দাগ কমে আসবে। এছাড়া কালো দাগের স্থানে টক দই দিয়ে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। এতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে ও কালো দাগ কমবে। রোদে পোড়া দাগ কমাতে আলুর রস বেশ কার্যকারী। শরীরের কালো দাগে আলুর রস ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া পিঠের কালো দাগ দূর করার জন্য গোলাপ জল, মুলতানি মাটি, দারুচিনি গুঁড়া খুব ভালো কাজ করে। টমেটোর প্যাক বানিয়ে পুরো পিঠে ম্যাসাজ করলে ধীরে ধীরে কালো দাগ ও ব্রণ কমে আসবে। কালো দাগ কমিয়ে উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসতে গাজরের রসের রয়েছে ভূমিকা। ত্বকের যত্নে মধুর উপকারিতা সম্পর্কে আর কারোরই অজানা নেই। তাই ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে ও মসৃণতা ফিরিয়ে আনার জন্য গোসলের আগে মধু শরীরে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। মধুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিসেপ্টিক এবং ব্যাক্টেরিয়ারোধী উপাদান ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে। এটা লোমকূপ উন্মুক্ত করে এবং ব্ল্যাকহেডস থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি সারাদিন ত্বক আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে।

ঘরোয়াভাবে শরীরের ত্বকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার করাও জরুরি। বডি কেয়ারে গোসলের সময় সাবান ভালো নাকি বডি ওয়াশ তা নিয়ে রয়েছে অনেক তর্ক বিতর্ক। অনেকেই মনে করেন বডি ওয়াশের অনেক দাম। সেক্ষেত্রে তারা বডি ওয়াশ বা শাওয়ার জেল এড়িয়ে গিয়ে সাবান ব্যবহার করেন। কিন্তু বডি ওয়াশের এক ফোঁটা অনেক বেশি ফেনা দেয় তাই দীর্ঘদিন বডি ওয়াশ ব্যবহার করা যায়। গোসলের সময় সাবানের চেয়ে বডি ওয়াশ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হাইজিনের কথা চিন্তা করলে বডি ওয়াশের চাইতে উত্তম আর কিছুই নেই। সাবান সাধারণত খোলা রাখা হয়। এর ফলে এতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে, যার ফলে ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং একটি সাবান পুরো পরিবার মিলে ব্যবহার করা কখনোই উচিত নয়। এতে একজনের শরীরের রোগ জীবাণু অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে বডি ওয়াশ বেশি নিরাপদ কারণ এটি বোতলে থাকে এবং পুরো পরিবার মিলে ব্যবহার করলেও তেমন অসুবিধা হয় না। সাবানে থাকে সোডিয়াম লরেল নামক সালফেল রাসায়নিক, যা শরীরকে অতিরিক্ত শুষ্ক করে তোলে। সেক্ষেত্রে বডি ওয়াশ কিংবা শাওয়ার জেল শরীরকে হাইড্রেট রাখতে সাহায্য করে। বডি ওয়াশের পিএইচ লেভেল সাবানের তুলনায় ভালো। বডি ওয়াশ ব্যবহার করে গোসলের পর রিফ্রেশ অনুভূতি হয় এবং ত্বক মসৃণ থাকে।

অনেকে মুখের ত্বকে মশ্চারাইজার ব্যবহার করলেও বডিতে মশ্চারাইজার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অবহেলা করেন। কিন্তু শরীর ঠিকমতো মশ্চারাইজ না থাকলে সেখানে শুষ্কতা দেখা দিয়ে র‌্যাশ চুলকানির মতো নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই ত্বককে মসৃণ রাখার জন্য সপ্তাহে ১ থেকে ২ দিন গোসলের আগে শরীরের তেল ম্যাসাজ করা যেতে পারে। ম্যাসাজ করার ফলে শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে ও ত্বক নরম থাকবে। এজন্য খাঁটি নারিকেল তেল ও অলিভ অয়েল বেছে নেওয়া যেতে পারে। গোসলের সময় আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক তেল অনেকটা কমে যায়। সেক্ষেত্রে তেল ম্যাসাজ করার ফলে ত্বক মসৃণ হয়ে ওঠে।

আমাদের ত্বকে অনেক সময় মৃত কোষ জমে যায়। শরীরের মৃতকোষ কমাতে নিয়মিত বডি স্ক্রাবিং করা জরুরি। বডি স্ক্রাব করলে শরীরে শুষ্কতাও কমে আসে। কিন্তু অনেকের শরীরে অনেক সময় অতিরিক্ত ব্রণের সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে স্ক্রাবিং করা উচিত নয়।

বডি মশ্চারাইজ করার জন্য আলাদা করে যেসব ময়েশ্চারাইজার পাওয়া যায় সেসব ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া শরীর অতিরিক্ত শুষ্ক হলে গোসলের পরে কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে বডি লোশন ব্যবহার করতে হবে। এখন প্রসাধনী তৈরি করা ব্র্যান্ডগুলো বডি কেয়ারের জন্য আলাদা করে বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করে থাকে। বডি কেয়ারের জন্য বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড বেছে নেওয়া যেতে পারে। অনেকে ভাবেন শরীর কাপড়ের নিচে ঢাকা থাকে তাই সেখানে সানস্ক্রিন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি মুখের পাশাপাশি শরীরের ত্বকেরও ক্ষতি করে থাকে। তাই নিয়মিত হাত ও পা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত মুখে যে সানস্ক্রিন দেই তা বডিতে ব্যবহার করা যাবে।

বডি কেয়ারের ক্ষেত্রে যত দামী প্রসাধনী ব্যবহার করা হোক না কেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প কিছুই হতে পারে না। শরীরের ত্বক সুস্থ রাখতে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। অনেকে অল্পতেই ঘেমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, সেক্ষেত্রে ঘেমে যাওয়া পোশাক দীর্ঘ সময় পরে না থেকে তা পরিবর্তন করতে হবে। পরিষ্কার সুতির কাপড় দিয়ে ঘাম পরিষ্কার করে নিতে হবে। শরীর দীর্ঘ সময় ঘাম কিংবা ভেজা ভাব থাকলে ফাংগাল ইনফেকশন সহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সৃষ্টি হতে পারে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। তাই র‌্যাশ কিংবা ফাঙ্গাল ইনফেকশন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: আরশী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − nine =