মানসম্মত বইয়ের প্রকাশ বাড়ছে

মাহবুব আলম : একুশ শতকের শুরুতে খুব সম্ভব ২০০২ অথবা ২০০৩ হবে, একুশের বই মেলা শেষে তৎকালীন দৈনিক আজকের কাগজের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয় ‘অধিকাংশই নিম্নমানের বই প্রকাশিত হয়েছে, মুষ্ঠিমেয় কিছু সংখ্যক বাদে।’ শুধু তাই নয় এর মধ্যে আবার অধিক সংখ্যক বই রীতিমত আবর্জনা। এই আবর্জনা প্রকাশের মধ্যে আনন্দ গর্ব কোথায়? আর কারা এই আবর্জনা প্রকাশ করে একুশের বইমেলার মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এই তদন্ত অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক। কিন্তু না, এ ব্যাপারে অনেকে একমত হলেও এ বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মানহীন বইয়ের প্রকাশ বেড়েছে। এই সংখ্যা এখন আকাশ ছোঁয়া। ২০২০-এর বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমির একটা বক্তব্যে বিষয়টা বেরিয়ে এসেছে।
২০২০-এর মেলা শেষে বাংলা একাডেমির কর্তৃপক্ষ জানায়-‘এবারের বইমেলায় চার সহস্রাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বড়জোর শ’চারেক বই মানসম্মত।’ এটা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এরপরও একটা সত্য বেরিয়ে এসেছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানসম্মত বই বেরুচ্ছে। এবং তা সংখ্যায় একেবারে কম নয়। শতকরা হিসাবে এই সংখ্যা ১০ ভাগ। পরিসংখ্যানের হিসাব মতে এটা অনেক কম হলেও এই সংখ্যাকে একেবারে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কারণ এটা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
এর জন্যে কোনো গবেষণা প্রয়োজন নেই। খালি চোখেই দেখা যায় সম্প্রতিক বছর গুলোতে যথেষ্ট ভালো বই বের হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সাহিত্য প্রকাশে তো রীতিমতো জোয়ার এসেছে। এই রাজনৈতিক সাহিত্যের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত ও বহুল বিক্রিত গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা।
এ ছাড়াও এ সময়ে প্রকাশিত রাজনৈতিক সাহিত্যের মধ্যে আলোচিত গ্রন্থ যতিন সরকারের পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন, হায়দার আকবার খান রনোর শতাব্দী পেরিয়ে, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাঙালীর জয় পরাজয়, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি, নেতা নেত্রী ও রাজনীতি, অধ্যাপক বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ও শ্রেণী সংগ্রাম, আধুনিকতা ও জাতীয়তাবাদ, হত্যার রাজনীতি ও বাংলাদেশ। মহিউদ্দিন আহমদের আওয়ামী লীগ উত্থান পতন পর্ব ১৯৪৮-৭০, বিএনপি সময় অসময়, জাসদের উত্থান পতন অস্থির সময়ের রাজনীতির, আলতাফ পারভেজের মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী- ইতিহাসের পুনঃপাঠ, পানি যুদ্ধ, মতিউর রহমানের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যা, রনেশ মৈত্রের বাংলাদেশ কোন পথে? এ বি এম আব্দুল্লাহর একাত্তরের স্বাধীনতা হঠাৎ করে আসেনি-ব্যাপক আলোচিত গ্রন্থ।
রাজনৈতিক সাহিত্যের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইতিহাস ভিত্তিক ভালো ভালো বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে হায়দার আকবর খান রনোর পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের দ্বিজাতি তত্ত্বের সত্যমিথ্যা ইত্যাদি গ্রন্থ।
রাজনৈতিক সাহিত্য, ইতিহাস গ্রন্থের পাশাপাশি বিজ্ঞানের উপর ভালো ভালো বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে, অসংখ্য অনুবাদ গ্রন্থ। আর মৌলিক সাহিত্য তো আছেই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশে অসংখ্য আবর্জনার মধ্যে অনেক অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যাকে বলা হয় ল্যান্ডমার্ক প্রকাশনা, এমন প্রকাশনার সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
এখানে একটা কথা বলা দরকার ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। দেশ ভাগের পর এই সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাও বিভক্ত হয়। কারণ এই চর্চার মধ্যমণিদের মধ্যে যারা মুসলমান তারা পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। অন্যদিকে হিন্দুরা রয়ে যান কলকাতায়। ফলে দেশভাগের ফলে যে ক্ষত ও শূন্যতা সৃষ্টি হয় তার থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাও বাদ পড়েনি। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় যে গভীর ক্ষত ও শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণ হতে দশকের পর দশক সময় লাগছে। এটা যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সত্য। তেমনি পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রেও। বরং পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রে এটা ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পূর্ব বাংলা তথা ঢাকার কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতি কর্মীরা সফল হয়েছেন। এর পরিণতি হিসেবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্র কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। কারণ বাংলা ভাষা-ভাষীরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশ করেছে।
তাই আমরা দেখি বাংলাদেশের ৫০ বছরে এদেশের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। এ দেশে আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান, শহীদুল জহির, রফিক আজাদ, ফজল সাহাবুদ্দিন, শহীদ কাদরী, হুমায়ূন আহমদ, হুমায়ূন আজাদ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানরা তাদের কালউত্তীর্ণ লেখনি দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সিপাই, শওকত ওসমানের জননী, শওকত আলীর প্রদোষে প্রকৃত জন, দিপিতার ঘরে, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, হুমায়ুন আহমদের নন্দিত নরকে, শামসুর রাহমানের বন্দি শিবির থেকে, নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই, রফিক আজাদের সীমাবদ্ধ জলে সমিত সবুজে, তুমিও আমার চুনিয়া অর্কেডিয়া, শহীদ কাদরীর উত্তরাধিকার, ফজল সাহাবুদ্দিনের অন্তর্গত হাহাকার, হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। এ সবই বিগত ৫০ বছরে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে। একে স্বাধীনতার সুফলও বলা যায়।
অতএব দেশে মানহীন, আবর্জনা প্রকাশের জন্য দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। তবে অবশ্যই মানহীন ও আবর্জনা প্রকাশের জন্য আমাদের ঘৃণা ও ধিক্কার দেয়া অব্যাহত রাখতে হবে। এবং চিহ্নিত করতে হবে কে বা কারা এগুলো প্রকাশ করছে। কেন করছে তাও জানতে হবে। এক্ষেত্রে আমার যতদূর জানা তাহলোÑ এক শ্রেণির প্রকাশক লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করছে। ফলে সে ক্ষেত্রে বইয়ের গুণাগুণ অর্থাৎ মান দেখার প্রশ্ন থাকে না। আবার এক শ্রেণির প্রকাশক আমলাদের পিছনে পিছনে ঘুরে ঘুরে ওদের দিয়ে বই লেখাচ্ছে যা অত্যন্ত বিপদজ্জনক। একইভাবে একশ্রেণির আমলা, রাজনীতিক নিজেদের প্রচারের মাধ্যমে হিসাবে ভাড়া করা লোক দিয়ে বই লেখাচ্ছে। আর প্রকাশকরা চোখ বন্ধ করে তা প্রকাশ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য অনেক নামি দামি প্রকাশনা সংস্থা এই অপকর্মে লিপ্ত হয়ে গেছে। আর ভূইফোড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোতো আছেই। এই অবস্থার অবসান না হলে মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা বাড়বে না। আর যতদিন না বাড়বে ততদিন পাঠকও বাড়বে না।
এখানে বলা দরকার দেশের পাঠকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অতীতে যে কোনো প্রকাশনা সংস্থা কমপক্ষে সাড়ে বারোশ বই ছাপতো। এখন তা কমতে কমতে দুই আড়াইশতে নেমে এসেছে। এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির অঙ্গনের সবাইকে। নয়তো এজন্য আমাদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে আশার কথা এই যে নতুন প্রজন্মের তরুণ লেখকদের মধ্যে অনেকে বিজ্ঞান ও গণিত চর্চায় মনোযোগী হয়েছে। ফলে বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে ভালো ভালো বই বের হচ্ছে। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে এখন, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয়গুলো। এমন কি ফুল, পাখি, নদ-নদী নিয়েও বই বের হচ্ছে। ফলে বিষয়ভিত্তিক বই প্রকাশনার নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে হবে। এ জন্য লেখক প্রকাশক ও অনুবাদকদের যথাপযুক্ত মূল্যায়ন আবশ্যক। প্রয়োজন সরকারের যথাযথ নীতিমালা ও মিডিয়ার সততা। মিডিয়ার সততার প্রশ্ন আসে এজন্য যে মিডিয়া আমলা লেখকদের বইকে যেভাবে উপস্থাপন করে প্রকৃত ও মৌলিক বিষয়ের লেখকদের যেভাবে মূল্যায়ন করে না। বরং ক্ষেত্রে বিশেষ অবমূল্যায়ন করে। একুশের মাসব্যাপী বই মেলার সময় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এ বিষয়ে যা ছাপা হয় তা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
অতএব মানসম্মত, রুচি সম্মত বইয়ের জন্য আমাদের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে প্রকাশকরা এ বিষয়ে আগ্রহী হয়। এ বিষয়ে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাঠাগার আন্দোলন। এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। যদি এটা করা সম্ভব হয় তাহলে অনেক বেশি মানসম্মত বই প্রকাশিত হবে। যা আজ অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine − 9 =