যৌতুক হবে কেন এটা উপহার

মাহবুব আলম

রুমা রাশেদকে ফোন করে বলল জরুরি কথা আছে। সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির ‘ক’ রেস্টুরেন্টে আস। ঠিক সাতটায়। বলে ফোনের লাইন কেটে দিল রুমা। রাশেদ রীতিমতো বিস্মিত। এমন কী জরুরি কথা। তারপর কোআে কথাবার্তা ছাড়াই ফোনের লাইন কেটে দিল। যাহোক, সন্ধ্যা সাতটায় যথারীতি হাজির হলো রাশেদ। কিন্তু রুমাকে দেখে হতভম্ভ হয়ে গেল। এ কী চেহারা হয়েছে। রুমার চেহারা দেখেই রাশেদের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা দেখা দিল। তারপরও ভাবল এই কয়দিনে এমনকি আর ঘটতে পারে। দুপক্ষই তো মেনে নিয়েছে। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করেছে। তারপর আর কি হতে পারে?

রাশেদ রুমার টেবিলে মুখোমুখি বসতেই কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই সোজা সাপ্টা বলল, ‘এ বিয়ে হবে না। হতে পারে না। যৌতুক দিয়ে বিয়ে করব না। আমাদের পরিবারের যৌতুক দেওয়া রেওয়াজ নেই।’ এক নিঃশ্বাসে এ কথা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমার সাথে দু’বছর প্রেম করলাম, এভাবে আর তার মূল্য দিতে হবে ভাবিনি। যাহোক সামলে নেব। ভালো থেকো।’ এই বলে রুমা চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। রাশেদ হতভম্ব হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। তারপর খুব নিচু স্বরে বলল, ‘এখানে যৌতুকের কথা কোত্থেকে আসলো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ ‘বাড়ি যাও বাড়ি গিয়ে বুঝে নিও।’ এ কথা বলার পর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না রুমা। সোজা গটগট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। আর রাশেদ রাগে, দুঃখে, অপমানে, লজ্জায় লাল হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ারে বসে রইল।

বাড়ি গিয়ে রাশেদ খোঁজ নিয়ে জানলো আজ সকালে তার বাবা-মা রুমাদের বাড়ি গিয়েছিল বিয়ের আনুষাঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে। তারা রুমার বাবাকে বলেছেন, বিয়াই আপনি তো নিজেই বলেছেন মেয়ের গহনাগাটি যা দেবার তা দেবেন। সেই সাথে ঘর সাজিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। তাই বলছিলাম কি গহনাগাটি যা দেওয়ার তা দেবেন। ও নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। আমাদের কথা হলো, আমার ছেলে ডাক্তার আপনার মেয়েও ডাক্তার। ডাক্তারদের একটা গাড়ি না থাকলেও ভালো দেখায় না। তাই যদি একটা ছোটখাটো প্রাইভেটকার দেন তাহলে ওদের খুব উপকার হবে। আপনারও সম্মান বাড়বে, মেয়ের বিয়েতে জামাইকে প্রাইভেটকার দিয়েছেন। খুব বেশি লাগবে না এমনিতেই তো ঘর সাজাতে সোফাসেট, খাট, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি কিনতে ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগেই। ওটা না দিয়ে ওই টাকার সঙ্গে আরো কিছু টাকা ভরে অনায়াসে একটা ছোটখাটো প্রাইভেটকার কেনা যাবে।

এটা শুনে রাশেদের চক্ষু চড়ক গাছ। এ কি করেছেন তার বাবা-মা। লজ্জা, অপমান আর ক্ষোভে রাতে ঘুম হলো না। সকালে নাস্তার টেবিলে বাবা-মার সামনে বিষয়টা তুলতেই তার বাবা রাশেদকে ধমক দিয়ে বলল, যা করার তোর ভালোর জন্যই করেছি।

তাই বলে তুমি যৌতুক চাইবে, যৌতুক নেবে?

যৌতুক কোথায়? এ তো উপহার। আমি উপহার দিতে বলেছি। দেখ, সমাজে আমাদের একটা মান-সম্মান আছে। তাই এই উপহারটা তোর প্রাপ্য।

রাশেদ এবার ওর মার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, মা তুমি কিছু বলো। বাবাকে বুঝাও। কিন্তু ওর মা তো আর এক কাঠি উপরে। ওর মা সোজা কথা একটা প্রাইভেটকারই তো চেয়েছি। বেশি কিছু তো চাইনি। ঘর সাজানো গয়নাগাটি নিয়ে তো আর কোনো দাবি করিনি। বলেছি যা পারেন দেবেন। এখন ওটাও দেবে না এটা কি করে হয়।

তাই বলে যৌতুক নেব?

যৌতুক কে বলেছে। ছি ছি যৌতুক নেব কেন? থাকগে এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। যা করার আমরাই করব ইত্যাদি বলে রাশেদের মা আলোচনার টেবিল থেকে উঠে গেল। আর রাশেদ রাগে দুঃখে গজগজ করতে করতে ডিউটিতে গেল।

রাতে বাসায় ফিরে শোনে সারাদিন বাড়িতে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খালা-ফুফুরাও এসেছিল। এসেছিল পাশের ফ্লাটের ভাবিরাও। সবার এক কথা। ছেলে ডাক্তার। ডাক্তার পাত্রের জন্য একটা প্রাইভেটকারের দাবি এমন কিছু না। আলোচনা হয়েছে যৌতুক নিয়েও। সবার এক কথা, যৌতুক নেওয়া ঠিক না। খুব অন্যায়। তবে পাত্রীপক্ষ খুশি হয়ে কিছু দিলে তাতে আপত্তি কোথায়? তাছাড়া পাত্রীর বাবা তো আর গরিব নয়, ফকিরও নয়; তাহলে আপত্তি কেন?

যৌতুকের বিরুদ্ধে এত নিন্দা, এত ঘৃণা, এত প্রচারের পরও এই হলো আমাদের আজকের অবস্থা। শিক্ষিত বিত্তবানরাও প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরিয়ে পেচিয়ে মুখোশের আড়ালে যৌতুক লেনদেন করছে। এ নিয়ে না আছে লজ্জা না আছে অনুশোচনা। উপরন্ত আছে গর্ব, তথাকথিত মান-সম্মান রক্ষার প্রতিযোগিতা। অথচ প্রশাসন, আইন, বিচার এখানে অন্ধ-কানা-বধির। এই অন্ধ-কানা-বধির সমাজ অব্যাহত রেখে যৌতুক প্রথার লজ্জা থেকে দেশ-জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। তাই শুধু গ্রামবাংলায় নয়, শহরের মুখোশধারীদেরও ধরতে হবে। ধরতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 − two =