কপ২৮ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর উন্নয়নের অঙ্গীকার কী এগিয়ে নেবে?

মুশফিকুর রহমান

জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের ইউনাইটেড আরব আমিরাতের দুবাই নগরী স্বাগত জানাচ্ছে। প্রতি বছরের মতো জাতিসংঘের সদস্য প্রায় ২০০ রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধি দল এবার ৩০ নভেম্বর সমবেত হবেন দুবাই নগরীতে। আশা করা যায় ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন শেষ করা সম্ভব হবে। বিশ্বজুড়ে বৈরী আবহাওয়ার নানা তাণ্ডব, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, কার্বন ট্রেডিং, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত মোকাবেলার কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজিত হবার সমস্যা ও তা সমাধানের পথ অন্বেষণসহ জলবায়ু সমস্যার সম্ভাব্য সব প্রসঙ্গ দুবাই সম্মেলনে আলোচিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং তার অভিঘাত মোকাবেলার পথ খোঁজার বাৎসরিক এ পরিক্রমায় জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ ইউনাইটেড আরব আমিরাতকে সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে বেছে নেওয়ার ঘটনা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক।

অবশ্য গত ২৮ বছর ধরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক দেশসমূহ সকলেই যে জলবায়ু পরিবর্তনে কেবল ইতিবাচক উদাহরণ তৈরির জন্য খ্যাতি কুড়িয়েছে তা দাবী করার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনকে জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ জলবায়ু পরিবর্তন, তার কারণ, প্রভাব, উত্তরণের উপায় নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার প্লাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে আগ্রহী। শিল্প ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশসমূহ দীর্ঘ কয়েক শতক জুড়ে বিশ্বের পরিবেশ ও আবহাওয়ামণ্ডলীকে কলুষিত করার জন্য প্রধানত দায়ী। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্ত। অন্যের করা অন্যায্য কাজের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় তারা কেন সইবে, জলবায়ু সম্মেলনে সে প্রশ্নও অন্যতম আলোচিত বিষয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও আবহাওয়ামণ্ডলীর অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তনের দায় এড়াতে চাইলেও জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো এখন সে দায় আংশিক হলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে নিজেদের পূরণ এবং অব্যাহত ‘পাপের’ দায়মোচনে কিছু ক্ষতিপূরণ, সহায়তার ঘোষণাও ধনী দেশগুলো দিয়েছে। তবে তাদের কথা আর কাজে অমিল রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ ও বিপর্যস্ত দেশসমূহ তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ, কারিগরি ও অর্থনৈতিক, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তার দাবী তুলে ধরার মোক্ষম ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র প্রথমবার একমত হয় যে, প্রাক শিল্পবিপ্লবের সময়ের সূচক থেকে বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি ২০৫০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পরিমাণ ধরে রাখা না গেলে বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয় অনিবার্য। এ লক্ষ্যে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ সিস্টেমে ‘নেট জিরো’ অর্জনের বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে সম্মত এ সম্পর্কিত প্রতিজ্ঞা পূরণে সামান্যই অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বরং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, বর্ধিত মাত্রায় গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের আয়োজন বেশ জোরে সোরে চলমান রয়েছে। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন এবং তারপরের সম্মেলনগুলোতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজেরা কে, কত পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করবে তার বিস্তারিত রূপরেখা পেশ করবার প্রতিজ্ঞা করেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে পরিকল্পনা প্রস্তুতি ও তা মেনে চলায় আন্তরিকতা স্পষ্টত লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। পূর্ববর্তী জলবায়ু সম্মেলন সমূহে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হ্রাস করবার বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে তার খতিয়ান পর্যালোচনা হবে।

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে সমৃদ্ধ অর্থনীতির অনেক ইউরোপীয় দেশ ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার সংকোচন করবার লক্ষ্যে আরও কঠোর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা পক্ষে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো এ জাতীয় এ্রকপেশে প্রতিশ্রুতি দিতে কতটুকু একমত হবে তা নিশ্চিত নয়। বিশেষত ভারত ও চীনের মতো বড় অর্থনীতি তাদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে অতিমাত্রায় কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তরল জ্বালানি ব্যবহারে নির্ভরশীলতা এতো দ্রুত সংকোচন করতে অনাগ্রহী। তাছাড়া ইউরোপীয়সহ বিশ্বের ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ইতিপূর্বে তাদের দেওয়া অসংখ্য প্রতিশ্রুতি নিয়মিত ভঙ্গ করেছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক যে, প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে শিল্পোন্নত ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে পিষ্ট দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবে সে প্রতিশ্রুতি তারা সামান্যই বাস্তবায়ন করেছে।

লন্ডনভিত্তিক ‘দি ইকোনমিস্ট’ গত ৩১ অক্টোবর ২০২৩ রিপোর্ট করেছে যে ইউরোপীয়, মার্কিন ও চীনের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলো ২০১৬-২০২২ সময়কালে ৪২৫টি জীবাশ্ম জ্বালানি আহরণ প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সমূহকে ১.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থের যোগান দিয়েছে। গত বছর ব্যাংকগুলো (জেপি মরগ্যান চেজ ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ব্যাংক অব অ্যামেরিকা, ওয়েলস ফারগো ব্যাংক, বিএনপি পারিবাস ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, বার্কলে’স ব্যাংক, আইসিবিসি ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক) ১৫০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ উল্লিখিত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। ‘দি গার্ডিয়ান’র বিবেচনায় বিশে^র শীর্ষ ব্যাংকগুলোর এ পদক্ষেপ বিশাল এক ‘কার্বন বোমা’ প্রকল্পে বিনিয়োগের সমতুল্য। পত্রিকাটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সম্মিলিতভাবে প্রকল্পগুলো আবহাওয়ামণ্ডলীতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করবে (প্রতিটি প্রকল্প আবহাওয়ামণ্ডলীতে প্রায় এক গিগা টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিংসরণের ঝুঁকি বহন করছে) তা পৃথিবীকে বিপদজনকভাবে উত্তপ্ত করার বিপদ ঠেকিয়ে দেবার সর্বশেষ সুযোগটিকে ধুলিস্যাৎ করে দেবে।

বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, কার্বন ডাই অক্সাইড সহ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার লক্ষ্যে কার্যকর ও দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে আগামী দশকের মধ্যে পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর ‘লক্ষণরেখা’ অতিক্রম করবে। ফলে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত আরও তীব্র হয়ে মানুষ, বন্য প্রাণী এবং সমগ্র জীববৈচিত্র্যের জগতকে আরও বেশি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। ‘সবুজ উন্নয়ন’ কৌশল অনুসরণ, কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানির ব্যবহার পরিহার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন ও তার বহুমুখী ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুয়োগ সৃষ্টি করবে।

ইউনাইটেড আরব আমিরাত জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবে। সম্মেলনের সভাপতি এবং দুটি শীর্ষ স্থানীয় নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা গত সপ্তাহে জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের সরকারকে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আবহাওয়ামণ্ডলীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার স্বার্থে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন সামর্থ তিনগুন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন সামর্থ তিনগুন বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনর বৈশ্বিক বিপর্যয় ঠেকাতে কেবলমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সামর্থ বৃদ্ধি এবং তা ব্যবহার নয়। জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি, মানুষের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি, সবুজ উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের অনুকূল আইনগত নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ, বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে বিপর্যয় ঠেকানোর পথে এগুতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seven − 2 =