কার্বন এবং দূষণ করারোপের মাধ্যম বছরে ৩.৪ বিলিয়ন ডলার সবুজ অর্থায়ন সম্ভব

শনিবার ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে “সবুজ অর্থনীতি ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু সম্পর্কিত বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১% কম এবং ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের তুলনায় বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় প্রকৃত বরাদ্দ ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমেছে। জলবায়ু সহনীয়তা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিতে বাজেটে জিডিপির প্রায় ৫% ব্যায় করা প্রয়োজন হলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়লেও জলবায়ু সম্পর্কিত বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৭০৬%, গত বছরের তুলনায় কমেছে।

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় এবারের বাজেটে পরিবেশ,বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ বেড়ে দুই হাজার ১৩০ কোটি টাকা বা ৫২ কোটি টাকা বাড়লেও বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। দুর্যোগ বাড়লেও কৃষি, স্বাস্থ্য এবং পানি সম্পদ খাতে জলবায়ু সম্পর্কিত বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক বা তার সামান্য বেশি। তীব্র দাবদাহ, শৈত্য প্রবাহ, মওসুমের বাইরে বৃষ্টিপাত সহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগ বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবা, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা এবং গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবাবস্থাপনায়  জলবায়ু সম্পর্কিত অর্থায়ন ক্রমেই কমছে। অভিযোজন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং গবেষণায় জলবায়ু সম্পর্কিত অর্থায়ন ক্রমেই কমছে।

প্যারিস চুক্তিতে সাক্ষরকারী দেশ হিসাবে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এনডিসিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪১১৪.২ মেগাওয়াট। প্রতি অর্থ বছরে গড়ে কম্পক্ষে প্রায় ৩ হাজার ৮৬ কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য শক্তি বাবদ মাত্র ১০০ কোটি টাকা বা মাত্র ৩.২% তহবিল বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। প্রতি অর্থ বছরে বাংলাদেশে সার্বিক জলবায়ু অর্থায়নে ঘাটতি ২৩.৪ বিলিয়ন ডলার। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হারানো কর্মদিবসের আর্থিক মূল্য বিবেচনায় সার্বিক জলবায়ু অর্থায়নে ঘাটতি বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতির তুলনায় আন্তর্জাতিক উৎস হতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। এ প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিশ্রুত প্রতি বছর ১১.৪ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় €২৫ বিলিয়ন (প্রায় ২৯.৩ বিলিয়ন ডলার) প্রদানের যে উদ্যোগ নিয়েছে জলবায়ু ঋণ না নিয়ে এ তহবিল থেকে অনুদান পেতে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে দ্বিপাক্ষিকভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। প্যারিস চুক্তির আওতায় সরকার জলবায়ু সহনীয়তার জন্য কার্বন নি:সরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর কার্বন কর আরোপ করা উচিত, তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি অভিযোজনেও বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে, পাশাপাশি কার্বন নি:সরণ কমে বায়ু দূষণের পরিমাণ কমে যাবে। কার্বন কর, দূষণ করারোপের মাধ্যম বছরে সর্বোচ্চ ৩.৪ বিলিয়ন ডলার সবুজ অর্থায়ন সম্ভব বলেও জানান জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান।

ক্রমবর্ধমান পানি, মাটি দূষণ সহ শ্রমিকের দেহের ভেতরে মাইক্রোপ্লাষ্টিকের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তৈরি পোষাকের ভোক্তার উপর পরিবেশ সংরক্ষণ ফি/করারোপের সুপারিশ জানিয়েছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির মূল্য প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার আমদানিকারক দেশ কর্তৃক দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ নীতিমালার আওতায় আমদানিকারক দেশ খুচরা ক্রয়ের ওপর ১০% হারে পরিবেশ সংরক্ষণ করারোপ করতে বার্ষিক প্রায় ২.১৩ বিলিয়ন ডলার (২৬,৪৫০ কোটি টাকা) রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। নির্দিষ্ট চুক্তির আওতায় করের টাকা বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষকরে নদী ও মাটি দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। এছাড়া ভারতের ক্লিন এনভায়রনমেন্ট আইনের ন্যায় বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানী আমদানির উপর ৫% থেকে ১০% পর্যন্ত কার্বন কর আরোপ করে বার্ষিক ২০৬০ থেকে ৪১২০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব। এছাড়া, প্লাস্টিক, ইট ভাটা, বিল্ডিং, দূষণকারী প্রতিষ্ঠান, পানি উত্তোলন ও বনভূমি কর্তনের উপর ৫% দূষণ করারোপের মাধ্যমে আরো ২৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব।

বাংলাদেশে বর্তমানে জলবায়ু খাতে প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান এম জাকির হোসেন খান, প্রয়োজনে অগ্রাধিকার তালিকা করে তালিকার নিচের দিকের খাতগুলোর অর্থ রিডিরেক্ট করে অভিযোজন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন, ফার্মার্স ব্যাংককে BCCTF প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ঋন দিয়েছিলো যা আজও শোধ হয়নি, BCCTF এর অবকাঠামো ও সুনাম জোরদারকরণে ওই অর্থ ফিরিয়ে আনানোর দাবি জানান তিনি।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ইতোমধ্যে গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ২০টি জেলায় ৩,৮৩,৮১৫ জন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে – অদূর ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে যাচ্ছে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ থেকে জানানো হয়, গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স এ ২০০০-২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৭ম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বব্যাপী গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে বাংলাদেশে বছরে দ্রুত এবং ৩.৪২ মিলিমিটার বেশি হারে বাড়ছে। শুধুমাত্র ক্রান্তীয় ঝড়ের কারণে বার্ষিক গড় ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।  ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩.৩ মিলিয়ন লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হতে পারে। বাংলাদেশ প্রায় ১০% আমন ধানের উৎপাদন হ্রাসের ঝুকির সম্ভাবনা আছে। জলবায়ুর ঝুকি সূচকে রংপুর এবং বরিশাল বিভাগ কাছাকাছি অবস্থান করলেও রংপুর বিভাগের তুলনায় বরিশালে বিসিসিটিএফ থেকে জনপ্রতি প্রায় ৯ গুণ বেশি তহবিল বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে সুশাসন নিশ্চিতে ২০২২ সালে সোয়াস, ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত গবেষণা এবং ২০১৯ বিসিসিটিএফ সহ বিসিসিটিএফ এর প্রকল্প মূল্যায়নের স্বচ্ছতা, জবাব্দিহিতা এবং শুদ্ধাচার নিশ্চিতে প্রকল্প এলাকার জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ সহনীয় পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং তদারকির নেতৃত্ব প্রদান করলে দক্ষতা এবং স্থায়িত্বশীলতা দুই-ই অর্জন সম্ভব। অভিযোজনে কার্যকর M&E কাঠামোর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা, আলোচনার দক্ষতা, স্টেকহোল্ডার এবং প্রতিষ্ঠানের M&E প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন, দুর্বল অভিযোজন, নারীদের অন্তর্ভুক্তি, বিভিন্ন লিঙ্গের মানুষ, যুবক, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করে চ্যাঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।

তাপপ্রবাহ কমাতে সমন্বিত কুলিং এবং গ্রিন জোন প্রতিষ্ঠা, কার্বন- নির্গমন ভিত্তিক কর ও দূষণ কর প্রবর্তন, জলবায়ু সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব করা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আরো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা উন্নত করা ও ভর্তুকিভিত্তিক দুর্যোগ বীমা চালু, অঞ্চলভেদে যথাযথ শুধুমাত্র সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেওয়া, শিল্প ও পরিবহন খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির মসৃণ রূপান্তর, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গভীর বনে টিলা এবং অধিক মিষ্টি পানির কূপ খনন বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেয়ার আহবান জানানো হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।

এছাড়াও টেকসই সমৃদ্ধি কৌশল ও পরিকল্পনা নিশ্চিতে জল, বন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার প্রদান করে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকৃতি ভিত্তিক টেকসই সমৃদ্ধি কৌশল প্রনয়ন; নীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার; টেকসই সমৃদ্ধি অর্থায়ন কৌশল প্রণয়ন; এবং সবুজ বাজেট বাস্তবায়নে জিডিপি’র কম্পক্ষে ৫% ব্যায় করা; দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের পাশাপাশি উদ্ভাবনী অর্থায়ন (যেমন, কার্বন ও দূষন করারোপ, অনুদান, যাকাত, ব্যাক্তিগত অনুদান, সবুজ বন্ড ইত্যাদি); সবুজ করনীতি প্রণয়ন, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সবুজ সেবা ও পণ্যকে সব ধরণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করারোপ হতে অব্যাহতি; দুর্নীতি, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি রোধে সব ধরণের নেতিবাচক প্রণোদনা এবং পরিবেশ-বান্ধব অবকাঠামো  পরিবহন ব্যবস্থায় আইনী বাধ্যতার সুপারিশ করে। এছাড়াও সবুজ প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে টেকসই সমৃদ্ধি সূচক প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে বাজেটে অর্থায়ন; পরিকল্পনার প্রতিটা স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ দখল এবং দুর্যোগের ঝুঁকিকে একীভূতকরণ; জাতীয়ভাবে খাত এবং জনগোষ্ঠীভিত্তিক পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা; দুর্বলতা মূল্যায়ন এবং ঝুঁকি বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার বরাদ্দ প্রদান; এবং জীবাশ্ম জ্বালানীতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে তা নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তি দক্ষতা, সবুজ উদ্যোগে ভর্তুকি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রকৃতি বান্ধব কৃষিতে বিনিয়োগে সবুজ কম্যুনিটি এন্টারপ্রাইজ এবং নাগরিককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের নেতৃত্ব প্রদানের কার্বন ও দূষন কর বাস্তবায়নে ডিজিটালভিত্তিক আদায়; প্রাথমিকভাবে তেল, কয়লা এবং গ্যাস থেকে কার্বন কর আদায়, কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিতে ভর্তুকিভিত্তিক জলবায়ু ঝূকি বীমা, সরবরাহে সহায়তা, ন্যায্য মূল্যে বিক্রয়ে ভর্তুকি চালু, দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানে অগ্রাধিকার প্রদান সহ নাগরিকের আচরণ পরিবর্তন এবং অবদান মূল্যায়ন-নির্ভর টেকসই উদ্যোগের প্রসারের সুপারিশ করে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten + eleven =