ভোক্তা অধিকার রক্ষায় প্রয়োজন জনসচেতনতা

সেলিনা আক্তার: মো. আমজাদ হোসেন ফেব্রুয়ারি মাসে পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশন থেকে কোহিনূর বেকারির একটি পাউরুটি কিনেছেন।তা খেয়ে পেটব্যথা অনুভব করলে মোড়ক লক্ষ করে তিনি দেখতে পান- তাতে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং মূল্য উল্লেখ করা নেই। এরপর তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করেন। ৪ মার্চ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পাবনা কার্যালয়ে আমজাদ সাহেব ও ওই বেকারির মালিকের উপস্থিতিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বেকারির মালিক দোষ স্বীকার করেন এবং এরপর থেকে পণ্যে সব তথ্য সংযোজন করবেন- এমন প্রতিশ্রুতি দিলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন এবং ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী অভিযোগকারীকে মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ প্রদান করার বিধি থাকায় তাকে ১ হাজার টাকা প্রদান করেন।

যিনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা চূড়ান্ত ভোগের জন্য ক্রয় করেন, অর্থনীতির ভাষায় তাকে ভোক্তা বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন কেবল নিজে ভোগ করার জন্য; তিনিই ভোক্তা। একজন ব্যক্তি যখন কোনো পণ্য ক্রয় করেন, তখন তার জানার অধিকার রয়েছে পণ্যটি কবে উৎপাদিত হয়েছে, কোথায় উৎপাদিত হয়েছে এবং এর কাঁচামাল কী কী, মূল্য কত ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। যদি কোনো বিক্রেতা এসব প্রশ্নের উত্তর না দেন বা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন আইন অনুযায়ী তাতে ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হলো- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এমনকি শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অনলাইনে কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে পণ্যের যে মান উল্লেখ থাকে, মূল্য পরিশোধের পর পণ্য হাতে পেয়ে দেখা যায় পণ্যের মধ্যে সেই গুণাগুণ নেই। তাই ভোক্তাকে এই আইন সম্পর্কে জানতে হবে এবং নির্ধারিত পন্থায় অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তাহলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও কমে আসবে।

ভোক্তা-অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৯ সদস্য বিশিষ্ট সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় ’ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব, এফবিসিসিআই এর সভাপতি, কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এর সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান, ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি, বিশিষ্ট নাগরিকসহ অর্থনৈতি, ব্যবসা, শিল্প ও জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন ব্যক্তি পরিষদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সমগ্র দেশে ভোক্তা-অধিকারকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এ আইনের ধারা ১০ অনুযায়ী সকল জেলায় জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘জেলা ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে এবং প্রবিধান ২০১৩ অনুসারে সকল উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট ও সকল ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ২০ সদস্য বিশিষ্ট ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। প্রতি মাসে এ সকল কমিটি মাসিক সভা ছাড়াও প্রচারণামূলক কার্যক্রমসহ সেমিনার ও দিবস উ`&যাপন করে থাকে, যার ফলে এ আইন সম্পর্কে সাধারন মানুষ পূর্বের তুলনায় এখন অনেক সচেতন হচ্ছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়,আরও প্রচার প্রয়োজন রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী একজন ক্রেতা যেসব বিষয়ে এই আইনের আওতায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন সেগুলো হলো (ক) বিক্রেতা পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করলে, (খ)মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করলে, (গ) সেবা তালিকা সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন না করলে, (ঘ) অধিক মূল্যে বিক্রয় করলে,(ঙ) পণ্য মজুদ করলে, (চ) ভেজাল পণ্য বিক্রয় করলে (ছ)খাদ্যদ্রব্যে নিষিদ্ধ পণ্য মিশ্রণ করলে, (জ) অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন করলে, (ঝ) মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা পণ্যের প্রচার করার মাধ্যমে প্রতারণা করলে, (ঞ) প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করলে, (ট) ওজন ও মাপে কারচুপি এবং দৈর্ঘ পরিমাপের ক্ষেত্রে কারচুপি, (ঠ) নকল পণ্য প্রস্তুত, (ড) মেয়াদোত্তীর্ন পণ্য বিক্রয় এবং অবহেলা।

ভোক্তা আইনের ৩৭ ধারায় পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করলে এক বছর কারাদণ্ডের বা ৫০ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে; ৩৮ ধারায় মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে; ৪২ ধারায় খাদ্য পণ্যের নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ করলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে; ৫২ ধারায় সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে পারে এমন কোন কাজ করলে তিন বছর কারাদণ্ড, বা দুই লক্ষ টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জুলাই/২২ থেকে ১৫ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত সারা দেশে ৮ হাজার ৫৬২টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। এরমধ্যে ১৮ হাজার ৬৫১টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে অভিযুক্ত করে ১৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬৪ হাজার ৬শত টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এই সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৮৩২টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬শত টাকা জরিমানা আদায় করে এবং অভিযোগকারীদের বিধি মোতাবেক ১৪ লাখ ৫ হাজারের ও বেশি টাকা প্রদান করেছে।

ভোক্তাদের জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘ভোক্তা বাতায়ন’ শীর্ষক হটলাইন (১৬১২১) চালু করেছে। এই হটলাইন স্থাপনের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোক্তারাও ঘরে বসেই অভিযোগ দায়েরসহ তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পাচ্ছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিকারমুলক সুবিধাও পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও ভোক্তাগণ অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ আছে; যোগাযোগের মাধ্যমগুলো হচ্ছে-ই-মেইল  info@dncrp.gov.bd মোবাইল ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ , ফোন ০২-৫৫০১৩২১৮ এবং হটলাইন ১৬১২১। অভিযোগ দায়ের ও প্রতিকারের জন্য কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংক্ষুব্ধ ভোক্তাকে কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উপযুক্ত প্রমাণসহ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট লিখিতভাবে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগটি সরাসরি/ /ডাকযোগে/ফ্যাক্স/ই-মেইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রেরণ করা যাবে। অভিযোগপত্রে অভিযুক্তের ঠিকানা,অভিযোগকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল এবং পেশা উল্লেখ থাকতে হবে। প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট অভিযোগ দায়ের করা যাবে।

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো ব্যবসাবাণিজ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক নানা সূচকে লক্ষণীয় উন্নতির ফলে এখন বিশ্ব অর্থনীতির এক অন্যতম উদীয়মান শক্তি বাংলাদেশ। আমাদের পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, আমদানি, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয় কার্যক্রমে মান উন্নয়ন হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় ভোক্তা চাহিদার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাজার ব্যবস্থা হতে হবে ভোক্তা বান্ধব ও নিরাপদ। খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাগণ ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্যের কুফল ও শাস্তি সম্পর্কে সচেতন হলে সবার জন্য উন্নত সেবা ও নিরাপদ পণ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে। আইন প্রণয়নের পর সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো আপামর জনগণকে আইনটি সম্পর্কে অবগত করা। ‘ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ সম্পর্কে অবহিত হলে ভোক্তারা যেমন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সদা সচেতন থাকবে তেমনি প্রতিকারের জন্য আইনের আশ্রয় প্রত্যাশী হবে। অপরপক্ষে ব্যবসায়ীরা ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য, অপরাধ ও দন্ড সম্পর্কে অবগত হলে ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য হতে বিরত থাকবে। নিরাপদ খাদ্য ও পণ্য নিশ্চিতকরণ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ভোক্তার আস্থাশীল উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বো, এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে ৬৪ টি জেলা ও ৪৩২টি উপজেলা পর্যায়ে মোট ৭৪০ টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন লক্ষ প্যাম্পলেট ৪ লক্ষ লিফলেট এবং ৩০ হাজার ক্যালেন্ডার বিতরণ করা হয়েছে।

পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 + 17 =