অপরাজিতা জামান
হলিউডের সবচেয়ে বড় ফ্রেমের তারকাদের তালিকা করলে প্রথম সারিতে থাকবে জনি ডেপের নাম। যার কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান’ সিরিজের কথা। এই সিনেমাগুলো দেখেননি এমন সিনেমাপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় সমুদ্রের জলরাশিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে মরণপণ লড়াইয়ের রক্ত হিম করা দৃশ্যগুলো। নিউরনে ধাক্কা দেওয়া ওই অভিনেতাই জনি ডেপ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্রাঙ্গনের বড় সুপারস্টার তিনি।
জনি ডেপ ১৯৬৩ সালের ৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকির ওয়েন্সবোরোতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জন ক্রিস্টোফার ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। জনির মায়ের নাম ওয়েট্রেস বেট্টি ডেপ। ক্রিস্টোফার ও বেট্টি দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে ছোট ছিলেন জনি। তার পুরো নাম জনি ক্রিস্টেফার ডেপ। জনির পরিবার ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো। আজ এখানে তো কাল ওখানে বাসা বাঁধত তারা। কোথাও থিতু হতে পারছিল না। পরে ১৯৭০ সালে ফ্লোরিডার মিয়ামিতে থিতু হন তারা। কিন্তু এই স্থায়ীত্ব সুখ এনে দিতে পারেনি ছোট্ট জনির মনে। কেননা ঘর যখন স্থায়ী হলো তখন আলগা হতে লাগল জনির বাবা-মায়ের সম্পর্ক। ফলে ১৯৭৮ সালে বিচ্ছেদ হয় জনির বাবা-মায়ের।
জনির বয়স তখন ১৫। বাবা-মায়ের সম্পর্কের অবনতি প্রভাব ফেলে সন্তানদের ওপর। জনির ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। ১৬ বছর বয়সে স্কুল থেকে ড্রপড আউট হন তিনি। তবে এর দুই সপ্তাহ পরই ভুল বুঝতে পারেন জনি। বই খাতা নিয়ে সুবোধ কিশোর সেজে ফের হাজির হন শ্রেণিকক্ষে। কিন্তু এবার বাধা দেন ওই স্কুলের অধ্যক্ষ। তিনি তাকে সংগীতশিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা দেন। জনি শিক্ষাগুরুর কথামতো হাতে তুলে নেন গিটার। সংস্কৃতি অঙ্গনে অভিনেতা জনির যাত্রা শুরু হয়েছিল সুরের হাত ধরে। মাত্র ১২ বছর বয়সে মায়ের মাধ্যমে তার ভেতর বাসা বেঁধেছিল সুর। মা বেট্টি ডেপ একটি গিটার কিনে দিয়েছিলেন জনিকে। সেসময় ক্ষুদে গিটারিস্ট হিসেবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বাজাতেন তিনি। এভাবেই কেটে যায় কয়েক বছর। পরে অধ্যক্ষের পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে তোলেন ‘দ্য কিডস’ নামে একট ব্যান্ড। এই গানের দলের শুরুটা বেশ ছিল। স্থানীয় ব্যান্ড হিসেবে ফ্লোরিডায় ভালোই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল দ্য কিডস। ফলে স্বপ্নটা আরও বড় করে দেখার সাহস পান জনি। পাড়ি জমান লস অ্যাঞ্জেলেসে। সেখানকার একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্য কিডসের চুক্তি করতেই শহরে এসেছিলেন তিনি। ব্যান্ডটির নাম পরিবর্তন করে তিনি রাখেন ‘সিক্স গান মেথড’। তবে লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে জীবিকার প্রয়োজনে টেলিমার্কেটিংসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে তাকে।
এভাবে থিতুহীন জীবন যখন চলছে, কখনও গিটারে সুর তুলে আবার কখনও পেটের দায়ে বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন; ঠিক তখন জনির জীবনে বসন্ত নিয়ে আসেন মেকআপ আর্টিস্ট লরি অ্যানি এলিসন। ১৯৮৪ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন তারা। তবে বেশিদিন এক পথে হাঁটেননি জনি-লরি। মাত্র এক বছরের মাথায় দুদিকে বেঁকে যায় তাদের দুজনার পথ। অবশ্য জনিকে নতুন পথের দিশা দেখিয়ে যান লরি। সে পথ হচ্ছে হলিউড। লরির মাধ্যমেই জনির বন্ধুত্ব হয়েছিল অভিনেতা নিকোলাস কেজের সঙ্গে। এই নিকোলাসের হাত ধরেই হলিউড যাত্রা হয়েছিল জনির। বন্ধুত্বের শুরুতে জনিকে অভিনয় নাম লেখাতে পরামর্শ দেন নিকোলাস। জনিরও অভিনেতার হওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল। এর পেছনে ছিল জেমস ডিন। তার জীবনী পড়ার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন প্রকট হয় জনির। আর এতে প্রভাবক হিসবে কাজ করেছিল ‘রেভেল উইদাউট এ কজ’ সিনেমাটি। তার হলিউড যাত্রায় যথেষ্ট অবদান রয়েছে নিকোলাসের। পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি। অভিনয়ে অনভিজ্ঞ জনিকে অডিশন দিতেও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। আর এভাবেই ভাগ্য জনিকে নিয়ে আসে অভিনয়ের প্লাটফর্মে। তবে শুরুতে এ অভিনেতা অভিনয় নিয়ে মোটেও সিরিয়াস ছিলেন না। এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অভিনয় নিয়ে মোটেও স্বপ্ন ছিল না তার। তিনি গান করাকালীন বেশ কিছু জায়গায় দেনা হয়েছিল তার। সেসব শোধ করতেই অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
চলচ্চিত্রে জনির পথচলা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। সে বছর ‘অ্যা নাইটমেয়ার অন ইলম স্ট্রিট’ নামের একটি ভৌতিক সিনেমার মাধ্যমে হলিউডে অভিষেক হয় তার। এরপরের বছরই ভেঙে যায় জনির কৈশোরে গড়া ব্যান্ডটি। তবে এই ভাঙন অতটা প্রভাব ফেলেনি। কেননা ব্যান্ড যখন ভাঙনের মুখে জনি তখন ক্যরিয়ার গড়তে ব্যস্ত। ১৯৮৭ সাল জনির ক্যারিয়ারের জন্য ছিল সোনা ফলা একটা বছর। এ বছর তিনি অভিনয় করেন ‘টুয়েন্টি ওয়ান জাম্প স্ট্রিট’ নামক একটি কানাডিয়ান টিভি সিরিজে। এই সিরিজই তাকে নিয়ে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়। সিরিজটি জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি তিনিও রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জন করেন। তবে ‘টুয়েন্টি ওয়ান জাম্প স্ট্রিট’ জনিকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকের কাছে। মূলত টিনেজ দর্শকরা তার প্রেমে পড়েছিল এই সিরিজ দেখে। অবশ্য সর্বশ্রেণির প্রিয় নাম হয়ে উঠতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি জনিকে। ১৯৯০ সালে জনি অভিনয় করেন ‘ক্রাই বেবি’ নামের একটি সিনেমায়। এ ছবি জনির ইমেজ রাতারাতি বদলে দেয়। সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার এটা ছিল প্রথম ধাপ। ১৯৯০ সালে দু’হাত খুলে দিয়েছে জনিকে। এ বছরই তাকে জনপ্রিয়তার রথে চড়ায় ‘এডওয়ার্ড স্কিসোরহ্যান্ড’ সিনেমা। ছবিটি তাকে সরাসরি প্রথম শ্রেণির অভিনেতাদের কাতারে নিয়ে এসেছিল।
ততদিনে এ অভিনেতাও বুঝতে পেরেছিলেন গান নয় ক্যামেরার সামনেই তার আসল কর্মক্ষেত্র। এডওয়ার্ড ছবির সাফল্যও জুগিয়েছিল প্রেরণা। এবার অভিনয়ে মনযোগী হন জনি। ছবিটি শুধু পেশাগত জীবনেই সাফল্য এনে দেয়নি, ব্যক্তিগত জীবনেও এনে দিয়েছিল মিষ্টি কিছু মুহূর্ত। এ ছবির শুটিংয়ের সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় হলিউডের অভিনেত্রী উইনোনা রাইডারের। দুজনে হৃদয়ের সম্পর্কে জড়াতে খুব একটা সময় নেননি। সম্পর্কের পাঁচ মাসের মাথায় বাগদান সারেন তারা। জনি রাইডারের প্রেমে এতটাই মজেছিলেন যে নিজের বাহুতে ট্যাটু করে লিখেছিলেন প্রিয়তমার নাম ‘উইনোনা ফরেভার’। নব্বই দশকে জনির পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন উভয়ই ছিল আলোচিত। মাদককাণ্ড, একাধিক প্রেমের কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি।
এই দশকে বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করে আলোচিত হন জনি। ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন একবিংশ শতকেও। ২০০১-০২ সালে কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এ ছবিগুলোও দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে জনির জনপ্রিয়তা তখনও হলিউডেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাকে বিশ্বব্যপী পরিচিতি এনে দেয় ‘পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান‘ ছবিটি। জনির ক্যারিয়ারের সব সাফল্যকে ছাপিয়ে দিয়েছে এই পাইরেটস ফ্র্যাঞ্চাইজি। এর শুরুটা হয় ২০০৩ সালে। গোর ভার বিনস্ক, রব মার্শাল নির্মিত এ ছবিটির প্রথম কিস্তি মুক্তির পরপরই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। আর এই আলোড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জনি ডেপ। বিশ্বব্যাপী ধুন্ধুমার ব্যবসায় সাফল্যের পর এ ছবিটি তাকে জায়গা দেয় বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড তথা অস্কারে।
এই অর্জনের পর জনিকে দেখা যায় ‘ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড’ নামের একটি ছবিতে। এখানে জনি নিজের সেরাটা দিয়ে সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে পান গোল্ডেন গ্লোবসহ দশটি পুরস্কার। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি জনিকে। একের পর এক ছবির মাধ্যমে ক্যারিয়ারের পথে সাফল্যের পথে হাঁটতে থাকেন তিনি। এ সময় তার ক্যারিয়ারে যোগ হতে থাকে ‘চার্লি অ্যান্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি’, ‘ক্যারিবিয়ান ডেড ম্যান’স চেস্ট’, ‘দ্য ইমাজিনেরিয়াম অব ডক্টর পার্নাসুস’, ‘পাবলিক এনিমিস’, ‘ডার্ক শ্যাডোস’র মতো প্রশংসনীয় চলচ্চিত্র।
জনি ডেপের জীবনে একাধিক নারী এসেছে। তবে কোনো নারীতেই থিতু হননি এ অভিনেতা। প্রণয় পরিণয়ের পর স্বভাবসুলভভাবেই করেছেন বিচ্ছেদ। তবে তাদের সবাইকে তিনি ভুলে গেলেও অ্যাম্বার হার্ডকে ভুলে যাওয়া কখনও সম্ভব না। এর আগে জনির জীবনে আসা প্রণয়িনীরা নীরবে চলে গেলেও অ্যাম্বার রীতিমতো নাকানি চুবানি খাইয়েছেন তাকে। ২০১৪ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তারা। সে ঘর সুখের হয়নি। কয়েক বসন্ত না ঘুরতেই দাম্পত্য কলহ শুরু হয় তাদের। এক পর্যায়ে অ্যাম্বার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেন জনির বিরুদ্ধে। জনিও পাল্টা মামলা ঠুকেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে জনির বিজয় হয়েছে শেষ অবধি। তবে খেসারত হিসেবে গঞ্জনা কম পোহাতে হয়নি। স্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের খবর তার ক্যারিয়ারে আঘাত করেছিল সাংঘাতিকভাবে। একের পর এক বিজ্ঞাপন, সিনেমার কাজ হারিয়ে প্রায় বেকার হয়ে পড়েন তিনি। এমনকি পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান থেকেও বাদ দেওয়া হয় তাকে। তবে সবাই মুখ ফিরিয়ে নেননি তার ভক্তরা। দুঃসময়ে প্রিয় তারকার পাশে ঢাল হয়ে ছিলেন তারা।
এদিকে অ্যাম্বারের সাথে বিচ্ছেদের পর জনিও কাটিয়ে উঠেছেন মানসিক ধকল। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ কান চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন তিনি। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার চলচ্চিত্র ‘জেন ডু ব্যারি’। এতে ফরাসী রাজা লুইয়ের ভূমিকায় রয়েছেন জনি। ছবিটির প্রিমিয়ার হয়েছে এ উৎসবে। সিনেমাটি দেখার পর দর্শকরা দাঁড়িয়ে টানা সাত মিনিট করতালি দিয়ে ভালোবাসায় ভাসিয়েছেন তাকে। এতে জনিও হয়ে উঠেছিলেন আবেগী। দর্শকের ভালোবাসা পেয়ে আপ্লুত জনি। প্রকৃত তারকা তো এমনই। শত বিতর্কের পর ভক্তদের কাছে দেবতা। তারকাকে ভালোবাসাই ভক্তদের ধর্ম। আর সেই ভালোবাসাই দিনশেষে সব বেদনার উপশম ঘটিয়ে আনন্দে কাঁদায় অভিনয়শিল্পীকে। আরও বহুপথ হাঁটতে জোগায় অনুপ্রেরণা। জনিই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি