বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কঠোর সমালোচনা ভারতের

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী এবং সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ ও ঢাকার সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রির সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং ওআরএফ কলকাতার পরিচালক অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী। ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিকবৃন্দের মধ্যকার এ আলোচনা অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে ভারতের অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা। এছাড়াও দুই দেশের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়েও কথা বলেন তারা।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকালে দিল্লির থিংক ট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে’ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর লেখা গ্রন্থ-‘ট্রান্সফরমেশন: ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইভোলিইশন অব ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ টাইজ’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন ও প্রশ্নের জবাব দেন ভিনা সিক্রি, শহীদুল হক এবং অনুসূয়া বসু রায় চৌধুরী। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন ওআরএফ দিল্লির সিনিয়র ফেলো তথা স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক সুশান্ত সারিন।

শীর্ষস্থানীয় এসব কূটনীতিকবৃন্দ বলেন, গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনের পক্ষে ভারতের কঠোর অবস্থান ছিল। এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ বলা যাবে না। বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অতি-সক্রিয়তাকে ভারত যে মোটেই পছন্দ করছে না সেটি জো বাইডেন প্রশাসনকে ভারত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। ভারতের কঠোর অবস্থানের পর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কার্যত আর সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেন তারা।

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বাইডেন প্রশাসনের কাছে দিল্লির স্পষ্ট ঘোষণা পৌঁছানোর পরেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে অনেকটা আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে তখন এই কড়া বার্তা শুনিয়ে দেওয়ার ফলেই  ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে  ভোটের সময় দেখাই গেলো না। অথচ  এর কিছুদিন আগেও তিনি অমুক বিএনপি নেতাকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে ডেকে আনছিলেন বা তমুক বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে হাজির হচ্ছিলেন। তারপর  তিনি! কোথায় যে গা ঢাকা দিলেন সেটা তিনিই জানেন!’

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ বলা যায় কিনা – এমন প্রশ্নের জবাবে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, কোনও দল যদি নিজেদের সিদ্ধান্তে নির্বাচনে না অংশ নেয়, তাহলে তার জন্য বিজয়ী দলকে দোষারোপ করা সাজে না। ভারতেও এমনটা দেখা যায়, যে দল জানে তারা ভোটে হারবে তাদের অজুহাতের অভাব হয় না। তারা অনেক আগে থেকে বলতে শুরু করে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র) কারচুপি করা হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে অন্যতম আলোচক ভিনা সিক্রি বলেন, তার মূল্যায়ন হলো আমেরিকা আসলে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে একটি ‘মডারেট’ (মধ্যপন্থি) ইসলামপন্থি দল হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের কোনও ধারণাই নেই যে জামায়াতের চিন্তাচেতনা ও কর্মকাল কতটা উগ্রবাদী। এ ‘ভুল ধারণা’র ভিত্তিতেই জামায়াত ও তাদের রাজনৈতিক সঙ্গী বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে আসছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে এই প্রসঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, জামায়াতের প্রকৃত রূপ জানার পরেও যুকাতরাষ্ট্র বিএনপিকে সমর্থন করার কারণ ভিন্ন।  সেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে বিদ্বেষমূলক একটা মনোভাব ছিল, তার প্রতিফলন আজও রয়ে গেছে। এ কারণেই অর্ধশতাব্দী পরেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ক্ষেপিয়ে দিতে এমনটা করছে দেশটি।

পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর বইতে ‘ভেক্সড ইস্যুজ’ নামে একটি চ্যাপ্টারে দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ভিনা সিক্রি বলেন, ‘আমার মতে দুই দেশ তিস্তার উৎস থেকে শুরু করে যৌথভাবে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে করলেই কেবল এই সংকট সমাধানের ফর্মুলা বেরোতে পারে। কারণ যেকোনও চুক্তি করার আগে তিস্তায় কখন কি পরিমাণ পানি থাকে, সেটা জানা খুব জরুরি। অথচ তিস্তার ক্ষেত্রে সেই তথ্যটাই আমাদের হাতে নেই।’

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ইউরোপের বেলগ্রেড থেকে অনলাইনে আলোচনায় অংশ নেন। তিনি পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর বইটির একটি অংশ থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের ‘নিয়তি যে এক সূত্রে গাঁথা’ এই কথাটি তিনিও অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেন।

দুই দেশের সম্পর্ককে ‘চিরায়ত বন্ধুত্বের সম্পর্ক’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক যে কৌশলগত সম্পকের্রও ঊর্ধে তা ২০১৫ সালে ঢাকা ও দিল্লির যৌথ বিবৃতিতেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখন। আমাদের দুই দেশের যথাযথ অনুভূতি আর মর্যাদা দিয়ে পরস্পরকে বুঝতে হবে। বাঙালিরা এমনিতেই খুব অনুভূতিপ্রবণ জাতি, সেটা নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশে কথিত ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার প্রসঙ্গ অবতারণা করে অনুসূয়া বসুরায় চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই আন্দোলনের কোনও ভিত্তি নেই এবং এটা নিয়ে চিন্তারও কিছু নেই, সেটা অত্যন্ত বলিষ্ঠ একটা পদক্ষেপ। এই তথাকথিত ক্যাম্পেইন যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু জনভিত্তিহীন আন্দোলনকারীদের কারসাজি সেটিও উল্লেখ করেন তিনি।

ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘অতি স্পর্শকাতর কৃষিপণ্য’ পেঁয়াজের রফতানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও রোজার মাসে শুধু বাংলাদেশকে যে ভারত তা থেকে ছাড় দিয়েছে, সেই ‘অনিয়ন ডিপ্লোমেসি’র পদক্ষেপকেও স্বাগত জানান অনুসূয়া বসুরায় চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × four =