চলচ্চিত্রে ‘সেন্সর’ যুগের অবসান, গঠিত হলো সার্টিফিকেশন বোর্ড

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে আতঙ্কের নাম ছিল সেন্সর বোর্ড। নির্মাণ শেষে সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হতো প্রতিটি সিনেমা। বোর্ডের সদস্যরা দেখে জানাতেন সিনেমাটি মুক্তির উপযোগী কি না! সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে দেওয়া হতো সেন্সর সার্টিফিকেট। এরপরই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার অনুমতি পেতেন নির্মাতারা। তবে সব সময় এত সরল হতো না প্রক্রিয়াটি। অনেক সময়ই নানা শর্তের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হতো সিনেমা। এভাবে বছরের পর বছর অনেক সিনেমা আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন সেসব সিনেমার নির্মাতারা। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে সেন্সর বোর্ড বিলুপ্ত করে সার্টিফিকেশন বোর্ড চালুর দাবি করে আসছিলেন।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে করা হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন। তবে নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় আগের সেন্সর বোর্ডই চলমান ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্মাতাদের আশা ছিল, সার্টিফিকেশন বোর্ড কার্যকর করে চলচ্চিত্র থেকে সেন্সরের খড়্গ তুলে দেওয়া হবে। তবে ১৫ সেপ্টেম্বর নতুন করে সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তখন জানিয়েছিলেন, সেন্সর শব্দটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সার্টিফিকেশন বোর্ড পুনর্গঠন করা হবে।

বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হলো রোববার। ২২ সেপ্টেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩-এর ধারা ৩-এর উপধারা (১)-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড।

১৫ সদস্যের এ বোর্ডে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গবেষক ড. জাকির হোসেন রাজু, প্রযোজক ও পরিচালক রফিকুল আনোয়ার রাসেল, প্রযোজক ও পরিচালক জাহিদ হোসেন, চলচ্চিত্র সম্পাদক ইকবাল এহসানুল কবির, পরিচালক খিজির হায়াত খান, তাসমিয়া আফরিন মৌ ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ। এ ছাড়া পদাধিকার বলে রয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব, একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি, বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি এবং চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান।

নতুন গঠিত সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্যরা সিনেমা দেখে মুক্তির অনুমতি দেবেন। তবে আগের মতো সেন্সর সার্টিফিকেট নয়, বরং প্রতিটি সিনেমার জন্য নির্দিষ্ট শ্রেণি নির্ধারণ করে মূল্যায়ন প্রতীকসহ সার্টিফিকেশন দেবেন তাঁরা। সারা বিশ্বে সিনেমা মুক্তির জন্য এ নিয়মই অনুসরণ করা হয়। এখন থেকে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিও সেন্সরের যুগ পেরিয়ে পা রাখল সার্টিফিকেশন অধ্যায়ে। এ উদ্যোগ বাংলা সিনেমার জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা।

নির্মাতাদের মতামত

বোর্ডের আইনটা নতুন করে লিখতে হবে, আরও গোছাতে হবে। পরিষ্কার করতে হবে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। আশা করি বোর্ডে যাঁরা আছেন, তাঁরা সঠিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন। নিশ্চয়ই সার্টিফিকেশন বোর্ডের এই যাত্রা আমাদের জন্য শুভ হবে। তবে সিনেমা হয় ট্যালেন্ট দিয়ে, ফ্যাসিলিয়েশনস—মানে সিনেমা নির্মাণের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। চলচ্চিত্র ভালো হবে নাকি খারাপ, সেটার সঙ্গে সার্টিফিকেশন বোর্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। ভালো সিনেমার জন্য সেন্সরের প্রয়োজন হয় না। সে জন্য দরকার চিন্তা আর মননের উপস্থাপন আর প্রকাশ করার ক্ষমতা।

—অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নির্মাতা

চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে, এটা খুব ভালো সংবাদ। ২০২৩ সালেই এটা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। একজন নির্মাতা কোনো ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর চিন্তার জায়গা থেকে একটা কাজ করলেন। কিন্তু দেখা গেল সেন্সর বোর্ড সেই দৃশ্যটাকে ছেঁটে ফেলতে বলল। এমনটা কিন্তু দেখেছি সেন্সর বোর্ডের ক্ষেত্রে। এখন এই সার্টিফিকেশন বোর্ডের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নতুন সম্ভাবনা। নিপীড়নমূলক যে আইন আছে, সেগুলো সংশোধন করে কীভাবে নতুন নীতিমালা তৈরি হয়, সেটা দেখার বিষয়। শুভেচ্ছা রইল যাঁরা এই বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমি বিশ্বাস করি, তাঁরা এমনভাবে নতুন করে নীতিমালা তৈরি করবেন, যাতে এই বোর্ড, সিনেমার জন্য ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। কোন সিনেমা কোন বয়সের দর্শকের জন্য তৈরি হয়েছে, তা নির্ধারণে এই বোর্ড ভূমিকা রাখবে।

—নূরুল আলম আতিক, নির্মাতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 + fifteen =