সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
এ লেখা যখন লিখছি তখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর হতে চলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর। জনাব মনসুর বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক। আগে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেশের আর্থিক খাতের একজন সুপরিচিত বিশ্লেষক।
নতুন পরিস্থিতিতে, অর্থনীতির সংকটের সময়ে এমন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞকে এই পদে নিয়ে আসা সবাইকে আশান্বিত করছে। গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ১৫ বছরের শাসনামলে অর্থনীতির বেহাল দশা, বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাট বরাবরই আলোচনায় ছিল।
বিগত কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছিল যে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে ব্যাংক খাতের অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মার্চ মাসে বলেছিল, ব্যাংক খাতের ক্ষত অতি গভীর। ১২টির অবস্থা খুবই খারাপ এবং এদের মধ্যে ৯টি ব্যাংক ইতিমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। অপর ৩টির অবস্থান ইয়েলো জোনে অর্থাৎ রেড জোনের খুব কাছাকাছি রয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্য ভালো আছে ১৬টি ব্যাংকের।
এক সময় অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, গণমাধ্যমের সমালোচনা সত্ত্বেও নতুন নতুন ব্যাংক দিয়েছে সরকার। এসব ব্যাংক বিতরণ করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে। সব আমলেই ব্যাংক বিতরণ করা হয়েছে শাসক দলের প্রিয়জনদের মধ্যে।
দীর্ঘদিন অনিয়ম, লুটপাট আর ঋণ খেলাপির সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে দিয়ে এখন সরকারের কপালে ভাঁজ। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থা এখন এমন জায়গায় গেছে যে কোনো কুল কিনারা করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকার। খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়েছে, বেড়েছে অনিয়ম।
সবার চোখের সামনে ফার্মার্স ব্যাংক বলে একটি ব্যাংক নাই করে দিল এর উদ্যোক্তা পরিচালকরা। বেনামি ঋণ থেকে শুরু করে যত প্রকার অনিয়ম করা যায় এই ব্যাংকটিতে হয়েছে চেয়ারম্যান ও কয়েকজন পরিচালকের মাধ্যমে। এক পর্যায়ে সরকার ব্যাংকটিকে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়ে পদ্মা ব্যাংক নাম দিয়ে নতুন করে চালু করে। সরকারি ব্যাংকগুলো শেয়ার কিনে, আইসিবিকে যুক্ত করে সরকার। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। একটি অত্যন্ত দুর্বল ব্যাংক হিসেবে কোনো রকমে চলছে এটি। আরেকটি সরকারি মালিকানার ব্যাংক বেসিক ব্যাংক। একজন চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেও দিব্বি পার পেয়ে গেছেন এই ব্যক্তি, শুধু ক্ষমতাসীন দলের সাথে যোগসাজশের কারণে। এই ব্যাংকটিও ধুঁকছে এখন।
আর্থিক খাতের আরেক বড় জালিয়াত প্রশান্ত কুমার হালদার যিনি পি কে হালদার নামে পরিচিত। এই ব্যক্তিও প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা নিয়ে দেশ থেকে চম্পট দিয়েছেন। এখন ভারতে তার বিচার হচ্ছে তাদের আইনে। পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। তার কারণে অস্তিত্বহীন হয়েছে পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন – এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে।
আরেক ব্যক্তি চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এস আলম। তার কব্জায় চলে গিয়েছিল সাতটির মতো ব্যাংক। এবং বলা হয় এস আলম গ্রুপ একটি ব্যাংকের টাকা দিয়ে আরেকটি ব্যাংক কিনেছে। বিপুল অংকের টাকা ঋণ নিয়েছে। একজন একক ব্যক্তির মালিকানায় এতগুলো ব্যাংক পুরো ব্যাংক খাতের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এগুলো সবই হয়েছে সরকারের আনুকুল্যে।
এ ছাড়া সরকার নিয়ম করেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচালক বানিয়েছেন যাদের কারণে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি হয়েছে, জনতা ব্যাংকে ঘটেছে আবুল বারকাত কেলেংকারি। হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক ঋণ কেলেংকারি হলো একটি ব্যাপক ঋণ জালিয়াতি যা বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে ৩৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেয় এমন ব্যক্তিকে যার কোনো বড় ব্যবসার রেকর্ডই ছিল না। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক আনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ব্যাংকটিকে শেষ করে দিয়েছেন। এই বারকাতের সময়ই এননটেক্স নামের এক প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক এবং সেটা করেছেন তিনি নিয়ম ভেঙে। আরও কয়েকটি গ্রুপকেও বড় ঋণ দিয়েছেন বিচার বিবেচনা ছাড়া।
এরকম দৃষ্টান্ত অসংখ্য। সরকার আইন করে প্রাইভেট বাংকগুলোতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের পরিবারের সদসদের জমিদারী প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্যাংক মানুষের টাকা দিয়ে ব্যবসা করে এবং সে জন্য আইনগতভাবে এটি পরিচালনা করবেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার কর্মকর্তারা। কিন্তু এখন ব্যাংক চালাচ্ছেন মালিকরা এবং সেটা হচ্ছে সরকারি প্রশ্রয়ে। তারা নামে বেনামে ঋণ নিচ্ছেন, ঋণ অনুমোদন দিচ্ছেন। তারাই ব্যাংক চালাচ্ছেন। সম্প্রতি একটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন মালিকদের এই বেনামি ঋণের চাপ সইতে না পেরে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শাসনব্যবস্থা নিয়েও গলদ প্রচণ্ড। নিয়ম অনুযায়ী সারা বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অভিভাবক। বাংলাদেশেও কাগজেপত্রে তাই। কিন্তু এ দেশে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে এক ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিভাগ। যার প্রধান একজন সচিব। পুরো আর্থিক খাতের ওপর সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব স্থায়ী করে রেখেছে এই বিভাগ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাইতে এই বিভাগের কাছেই বেশি ধর্না দেয় ব্যাংক মালিকরা। এর বিলুপ্তি দ্রুত করতে হবে।
জনপরিসরে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সম্পর্কে কোনো আস্থাই আর অবশিষ্ট নেই। আর্থিক খাত চলে মানুষের আস্থায়। আশা করছি নতুন গভর্নর সেই আস্থা ফেরাতে পারবেন।
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সাংবাদিক লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: দিনদিন