রোজ অ্যাডেনিয়াম
গত মাসে সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন সকলের প্রিয় শিল্পী হাসান আবেদুর রেজা জুয়েল। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন ভালো গায়ক, উপস্থাপক ও নির্মাতা। জুয়েলের জন্য শোক প্রকাশ করছে রঙবেরঙ।
মা-বাবার জন্যই গানের জগতে
হাসান আবেদুর রেজা জুয়েলের জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ব্যাংকার বাবার চাকরির কারণে ছোটবেলায় তাকে থাকতে হয়েছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মা-বাবার অনুপ্রেরণাতেই গানের জগতে পা রাখেন জুয়েল। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রতিবেশী একজনের কাছে গান শিখেছিলেন আর মঞ্চে প্রথম গান করেছিলেন তখন তিনি পড়েন চতুর্থ শ্রেণিতে। ব্যান্ড সংগীত যখন তুমুল আলোচনায়, ঠিক তখনই ব্যতিক্রমী কণ্ঠ নিয়ে হাজির হন শিল্পী জুয়েল। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চলে আসেন জুয়েল। এসেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন। তখনই বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটতে শুরু করে।
যতো গান
নব্বই দশকের জমজমাট অডিও ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম চমক হিসেবে ধরা দিয়েছেন হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। আইয়ুব বাচ্চুর সুরে প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’ প্রকাশ হয় ১৯৯৩ সালে। প্রথম অ্যালবামেই বাজিমাত করেন জুয়েল। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘এক বিকেলে’ (১৯৯৪), ‘আমার আছে অন্ধকার’ (১৯৯৫), ‘একটা মানুষ’ (১৯৯৬), ‘দেখা হবে না’ (১৯৯৭), ‘বেশি কিছু নয়’ (১৯৯৮), ‘বেদনা শুধুই বেদনা’ (১৯৯৯), ‘ফিরতি পথে’ (২০০৩), ‘দরজা খোলা বাড়ি’ (২০০৯) এবং ‘এমন কেন হলো’ (২০১৭)। এছাড়াও বেশ কিছু সিঙ্গেল ও মিশ্র অ্যালবামে গেয়েছেন জুয়েল। সংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও তার আরও একটি বড় পরিচয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে। পাশাপাশি সঞ্চালনাও করেছেন অনেক অনুষ্ঠানে।
জুয়েলের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গানের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
সেদিনের এক বিকেলে: ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘এক বিকেলে’ শিরোনামের অ্যালবামে ছিল এই গান। এটি লিখেছেন সৈয়দ আওলাদ। গানের কথাগুলো ‘সেদিনের এক বিকেলে/ তোমার চোখে জল দেখেছি/ সে কথা আমি কতরাত/ একা একা ভেবেছি/ আর জানি না কেন এত কষ্ট পেয়েছ তুমি?’ সুর ও সংগীত করেছেন প্রয়াত রক কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু।
চিলেকোঠায় এক দুপুরে: গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখায় গানটি গেয়েছিলেন জুয়েল। এটিও ছিল ‘এক বিকেলে’ অ্যালবামে। সুর-সংগীত করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। অ্যালবামটি বাজারে এসেছিল এমএআরএস মিউজিকের ব্যানারে।
ওগো চন্দ্রদ্বীপের মেয়ে : জুয়েলের ‘এক বিকেলে’র প্রায় সব গানই জয় করে নিয়েছিল শ্রোতাদের হৃদয়। এই গানটিও সেই অ্যালবামের। এর কথা লিখেছেন প্রয়াত গীতিকার-জ্যোতিষী কাওসার আহমেদ চৌধুরী। অন্য গানগুলোর মতো এর সুর-সংগীতও করেন এলআরবি’র দলনেতা কিংবদন্তি গায়ক-গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু।
কোথায় রাখ আমাকে: প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’-এ জুয়েলের এই গানটি বেশ শ্রোতানন্দিত হয়েছিল। এর কথা লিখেছেন আইয়ুব বাচ্চু। সুর-সংগীতও করেছিলেন তিনিই। গানের কথাগুলো এমন -‘কোথায় রাখ আমাকে তুমি বল না/ দৃষ্টি না হৃদয়ে আমি জানি না/ কোথায় আছি আমি তা জানি না/ তোমার সুখে না দুখে তুমি বল না?’
ফিরতি পথে: ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় জুয়েলের অষ্টম অ্যালবাম ‘ফিরতি পথে’। একই শিরোনামের গানটি পেয়েছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মূলত কথা আর গায়কিতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন গায়ক। গানটি লিখেছেন গীতিকবি জুলফিকার রাসেল।
জানি না মনে রাখ কিনা: জুয়েলের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে এটি দারুণ সাড়া ফেলে শ্রোতামহলে। ‘জানি না মনে রাখ কিনা’ গানটি প্রকাশ হয় ২০০৯ সালে, ‘দরজা খোলা বাড়ি’ অ্যালবামে। লেজার ভিশনের ব্যানারে গানটির কথা-সুর ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর। এ ছাড়াও জুয়েলের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘অনন্যা’, ‘সারা শহর উড়ছে খবর’, ‘যত দূরে যাই’, ‘ফেরারি আমি’, ‘তুমি নেই’, ‘দুপুরবেলা নতুন চিঠি’, ‘ফুলগুলো তোমারই থাক’, ‘চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে’ ইত্যাদি গানগুলো।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই
১৩ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করলেন হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে তার চিকিৎসাসেবাও চলছিল। জুয়েলের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে তার লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর ফুসফুস এবং হাড়েও ক্যানসার সংক্রমিত হয়। তখন থেকেই দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে তার চিকিৎসাসেবা চলছিল। ২৩ জুলাই তাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ৩০ জুলাই ২০২৪ মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিরবিদায় নেন ‘সেদিনের এক বিকেলে’-খ্যাত এই শিল্পী। জুয়েলের বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর।
পরিবার
একটা ছোট্ট পরিবার ছিল জুয়েলের। তার স্ত্রী ছিলেন সংবাদ পাঠিকা সংগীতা আহমেদ। তাদের এক কন্যাসন্তান আছে। সবাইকে ছেড়ে এখন ওপারে ঘুমাচ্ছেন প্রিয় গায়ক।
মৃত্যুতে তারকাদের শোক
আবিদুর রেজা জুয়েলের মৃত্যুতে দেশের সংগীতানুষ্ঠানে নেমে আসে শোকের ছায়া । শোক প্রকাশ করেছেন তার সহকর্মী তারকা শিল্পীরা। গণমাধ্যমে নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেছেন, জুয়েল ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলে গেল, ভাবতেই পারছি না। আমাদের সবাইকে তো একদিন চলে যেতে হবে। শাফিন ভাইয়ের পরপরই জুয়েলের মৃত্যু! একসঙ্গে দুটি মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জুয়েলের কিছু গান আছে এখনও শ্রোতারা মনে রেখেছে। সে সবসময়ই ভালো গান গাওয়ার চেষ্টা করত। বিরহের গানই বেশি গাইত। প্রত্যেকটি গানই একটি মাত্রা রাখে। গানের কথা, সুরে ভিন্নতার ছাপ ছিল। আমার উপস্থাপনায় ‘সুরের আয়না’ নামে একটি অনুষ্ঠানে তাকে ডেকেছিলাম। অনেক কথা হলো সেই অনুষ্ঠানে। অসাধারণ কিছু গান শুনলাম। তার অস্থিরতায় মিশে যাওয়ার মানসিকতা কখনই ছিল না। পথচলাটাই ছিল সুন্দর।
‘তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’ প্রয়াত এই শিল্পীকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আরেক শিল্পী নকীব খান। গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘হঠাৎ করে খবর পেলাম হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল আর নেই। শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। শাফিনের পর জুয়েলও চলে গেল। একে একে প্রিয় মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর নিতে পারছি না। এত প্রতিভাবান একটা ছেলের চলে যাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রির অপূরণীয় ক্ষতি হলো। জুয়েল যখন গান গাইতে শুরু করেছিল তখনই আমার সঙ্গে পরিচয়। বাচ্চুর (আইয়ুব বাচ্চু) সঙ্গে সে অনেক কাজ করেছে। আমরা একসঙ্গে ‘সংগীত ঐক্য’ নামে একটি সংগঠনও করেছি। জুয়েল স্টেজ উপস্থাপনায়ও ছিল দারুণ। তথ্যচিত্র নির্মাণেও রেখেছে সফলতার স্বাক্ষর। সবকিছু মিলিয়ে সে কমপ্লিট একটা কালচারাল মানুষ ছিল। জুয়েলকে আল্লাহ ভালো রাখুক, এ প্রার্থনাই করছি।’ প্রয়াত এই শিল্পীকে নিয়ে দেশের একটি গণমাধ্যমে স্মৃতি কথা লিখেছেন সংগীত তারকা বাপ্পা মজুমদার। বাপ্পা মজুমদার লিখেছেন, ‘১৯৯২ সালে জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। জুয়েল ভাইয়ের উদ্যোগেই আমার প্রথম অ্যালবাম করা এবং প্রকাশ করা। অ্যালবামের নাম ‘তখন ভোরবেলা’। সেই অ্যালবাম দিয়েই শিল্পী বাপ্পা মজুমদার হিসেবে আমার পথচলা শুরু। জুয়েল ভাইয়ের মাধ্যমেই আমার পরিচয় হয় সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে। তারপরেই তো দলছুটের জন্ম। মা, বাবা আর বড়দার পরে আমার জীবনে দুজন মানুষকে আমার মেন্টর হিসেবে বিবেচনা করি। একজন হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, অন্যজন সঞ্জীব চৌধুরী।’ বাপ্পা আরো লিখেছেন, ‘অল্প কদিন আগেই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে। কথা বেশি দূর এগোয়নি। যখন হাসপাতালে গিয়েছিলাম, তখন তিনি আইসিইউতে। ডাক্তাররা তখন কাউকেই অ্যালাউ করেননি। মন থেকে চাইছিলাম, জুয়েল ভাই যেন চলে না যান, সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন আমাদের মাঝে। তা আর হলো না। সারাটা জীবন খুব মিস করব জুয়েল ভাইকে।’ গায়ক শুভ্র দেব বলেন, ‘জুয়েল অনেক ক্রিয়েটিভ একজন মানুষ ছিল। তার অনেক জনপ্রিয় গান আছে। সত্যি কথা বলতে কি, জুয়েলের আসলে চলে যাওয়ার সময় হয়নি। আমি আজকে খুবই আপসেট। ওর চলে যাওয়া সংগীতাঙ্গনের এক অপূরণীয় ক্ষতি।’ সুরকার প্রিন্স মাহমুদ বলেন, ‘জুয়েল ভাইয়ের সাথে আমার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তার সাথে আমার অনেক বোঝাপড়ার একটি সম্পর্ক ছিল। শুরুর দিকে আমরা একসাথে অনেকগুলো কাজ করেছিলাম এবং প্রত্যেকটি কাজই মানুষজন খুব পছন্দ করছিল। যেমন ‘বোঝনি’, ‘ভালোবাসা কাকে বলে’, ‘তোমার কাছে’, ‘জীবন মরণ আমার কাছে’সহ বেশ কিছু গান। জুয়েল ভাইয়ের কাজের মাধ্যমে আমরা তাকে স্মরণ করব।’ সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা পার্থ বড়ুয়া জুয়েলের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমি জুয়েলের মুখে কোনোদিন নেগেটিভ কথা শুনিনি। তিনি চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত ভালো হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি শুধু সংগীতশিল্পী না, একজন ভালো নির্মাতা ছিলেন। আমার কোনো সমস্যা হলে তাকে ফোন দিতাম। তিনি সবসময় আমাকে সহযোগিতা করেছেন। মিউজিশিয়ান ও ডিরেক্টর একসাথে হওয়ার জন্য তিনি ছিলেন আমাদের সম্পদ। আমরা তাকে হারালাম। এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টদায়ক।’
চিরনিদ্রায় শায়িত
হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল চিরনিদ্রায় শায়িত হন ৩০ জুলাই। মাগরিবের নামাজের পর রাজধানীর বনানী কবরস্থানে। এর আগে প্রথম জানাজা হয় গুলশান আজাদ মসজিদে, এরপর নেওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এই শিল্পীকে। এসময় জুয়েল স্বজনরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংগীতাঙ্গনের অনেকেই। সবাই প্রার্থনা করেন শিল্পীর জন্য। ওপারে ভালো থাকুন সবার প্রিয় শিল্পী জুয়েল।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ