জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বৈশ্বিক তাগিদ এবং চ্যালেঞ্জ

মুশফিকুর রহমান

অন্তবর্তী সরকারের দেওয়া ঘোষণা ‘কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণকারীগণ রাত্রি যাপন করতে পারবেন না’ এবং  ‘দ্বীপটিতে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হবে’ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা চলছে।

১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে সরকার প্রথমবারের মতো ‘পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে। প্রধানত দ্বীপটির পরিবেশগত স্পর্শকাতর অবস্থান এবং দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের তাগিদ থেকে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সরকারের ঘোষণা কার্যত কাগজে কলমেই সীমিত ছিল। ঘোষণার পর থেকে ছোট দ্বীপটিতে (প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি ৫.৬৩ কিলোমিটার উত্তর দক্ষিণে লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ২০০-৭০০ মিটার চওড়া) বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের সামান্য আয়তনের ভেতরে বসবাসকারী প্রায় দশ হাজার মানুষের পাশাপাশি প্রতিদিন প্রায় আরও আট থেকে দশ হাজার ভ্রমণকারীর চাপ। দ্বীপের প্রতিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকায় ভ্রমণকারীদের নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল, দ্বীপের কোরাল, ঝিনুক, সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম, সামুদ্রিক প্রাণী নির্বিচার সংগ্রহ বা ধ্বংস, দ্বীপের পরিবেশ স্পর্শকাতরতা উপেক্ষা করে কোলাহলপূর্ণ বিভিন্ন উদযাপন, দ্বীপে আসা সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণী ও কচ্ছপদের জীবন বিপন্ন করা কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। ইতিমধ্যে গবেষণায় উঠে এসেছে যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একসময় অন্তত ১৫৪ প্রজাতির সামুদ্রিক শেওলা, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫৭-১৯১ প্রজাতির শামুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, ১২০ প্রজতির পাখি, চার প্রজাতির উভচর এবং ২৯ প্রজাতির সরিসৃৃপ জাতীয় প্রাণীর বসবাস ছিল। গত ৩৭ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কোরাল আচ্ছাদন ১.৩২ বর্গ কিলোমিটার থেকে সঙ্কুচিত হয়ে ০.৩৯ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে । ১৪১ প্রজাতির কোরালের সমৃদ্ধ চিত্র সঙ্কুচিত হয়ে এখন সেখানে মাত্র ৪০ প্রজাতির কোরালের দেখা মেলে। দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সেন্ট মার্টিনে কোরালসহ প্রকৃতির অনেক সদস্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দ্বীপটিতে অনতিবিলম্বে বিপুল মানুষের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দ্বীপের ভূগর্ভের পানীয় মিঠাপানির সঞ্চয় দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া মানুষের সৃষ্ট জৈব আবর্জনাসহ বিভিন্ন অপচনশীল ও ক্ষতিকর আবর্জনা সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী এবং প্রতিবেশগতভাবে পুনর্ভরণের অনুপযোগী স্থানে রূপান্তরিত করবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তগণ আশা পোষণ করেন যে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক ঢল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ পুনরুজ্জীবিত করা ও দ্বীপকে সামুদ্রিক প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষণ সম্ভব হবে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কেবল আমাদের দেশজ ভাবনার বিষয় নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই জীববৈচিত্র্য সঙ্কুচিত হওয়া, পরিবেশের সদস্যদের বিপন্ন থেকে বিলুপ্ত হবার নানামূখী ঝুঁকি প্রকট হয়ে উঠছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড         ২০২২ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছে যে ১৯৭০ সাল থেকে ২০২২ সময়কালে পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী জগতের অন্তত ৬৯% সঙ্কোচন ঘটেছে। গত ৫০ বছরে পৃথিবীর বন্য প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৭৩%। জীববৈচিত্র্যের এই দ্রুত সঙ্কোচন মানুষের জন্য ভীষণ উদ্বেগের খবর। যদিও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার তৎপরতা জোরেসোরেই চলছে। অথচ, আমাদের সকলের জন্যই আমাদের চারপাশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও আন্তঃসম্পর্কিত প্রতিবেশ ব্যবস্থার সুস্থ্য বিকাশ সম্পর্কে সচেতন থাকা অপরিহার্য। আমাদের জীববৈচিত্র্য থেকে আমাদের খাদ্যের যোগান আসে। আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় প্রকৃতিকভাবে যে উদ্বিদ, প্রাণী, কীট-পতঙ্গ ও এককোষী অণুজীব জগৎ রয়েছে তার পরস্পর নির্ভরতা মানুষের বৈচিত্র্যময় খাদ্য ও ঔষধের উপাদান যোগান দেয়। ছোট্ট মৌমাছি বা হামিংবার্ড হঠাৎ নাই হয়ে গেলে ফুলের পরাগায়ন ঘটবে কী করে সে ভাবনা কেন আমাদের উদ্বিগ্ন করে না? পরাগায়ন না হলে শষ্য দানা, ফল-মূল, তেল-বীজ, শাক-সবজির যোগান কোথা থেকে আসবে?

আমরা কত শত রোগ বালাইয়ের মুখোমুখি হই, নিরাময়ের জন্য ভিষক, আয়ুর্বেদ বা ডাক্তারের কাছে ছুটি। তারা যে রোগ নিরাময়ের ঔষধ বা পথ্য আমাদের অনুসরণ করতে বলেন সেগুলোর যোগান কোথা থেকে আসবে যদি না আমরা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করি। তাছাড়া, নতুন নতুন কত শত রোগ-বালাই এর খবর আমরা জানছি। সেগুলোর প্রতিকার বা প্রতিরোধের কী হবে, যদি না আমরা আমাদের প্রকৃতির জগতে সংরক্ষিত জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা ভারসাম্যপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখি। অনাগত দিনের গবেষণার ভান্ডার এখনই উজাড় করে নিঃশেষ করলে, প্রয়োজনের গবেষণা উপকরণ কোথা থেকে আসবে? আমরা কী ভেবে দেখেছি, জীববৈচিত্র্যের অব্যাহত সঙ্কোচন চলমান থাকলে তার আর্থিক ও অর্থনৈতিক মূল্য কত হবে? জীববৈচিত্র্যের উপস্থিতির জন্য যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে তার সঙ্কোচন কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে? বিপুল সংখ্যক শিল্প কারখানার কাঁচামালের যোগানও কিন্তু জীবজগতের বৈচিত্র্য থেকে আসে। জীববৈচিত্র্য সঙ্কুচিত হলে শিল্পকারখানার বিশাল অংশ অচল দাঁড়িয়ে থাকবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ইতিমধ্যে জীববৈচিত্র্যের দ্রুত সঙ্কোচন এবং বিলুপ্তি ঘটছে। বদলে যাওয়া তাপমাত্রাসহ আবহাওয়ার বৈরী পরিবর্তন কৃষি, ফসল উৎপাদন এবং খাদ্যের যোগান অব্যহত রাখার জন্য এখনই চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতির যে সদস্যগণ বিলুপ্ত হতে বাধ্য হবে, তাদের বিকল্প কী সহজে এবং সুলভে মানুষের জন্য সরবরাহ করা যাবে?

উপরোক্ত প্রশ্নগুলো মাথায় থাকলে সম্পদের অতি আহরণ, জীববৈচিত্র্যে স্বাভাবিক সংরক্ষণ ও বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত রাখা পরিবেশের দূষণ প্রতিরোধ, আগ্রাসী প্রাণী ও উদ্ভিদের বিস্তার রোধ করবার প্রয়োজনীয়তা মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠার কথা।

এ প্রশ্নগুলো সচেতন মানুষদের ভাবাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে। গত ২ নভেম্বর ২০২৪ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় শেষ হলো (২১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ২০২৪) জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সম্মেলন। সম্মেলনে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিসহ প্রায় ২০০ দেশের প্রতিতিধি, বিজ্ঞানী, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিগণ পৃথিবীর বিপন্ন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায়, আয়োজন, তহবিল গঠন ও তার পরিচালনা, আদিবাসী জনগোষ্ঠির স্বার্থ সংরক্ষণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসকারী ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিভিন্ন ভর্তুকি সুবিধা সঙ্কোচনের পথ, তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে পরিবেশে সৃষ্ট বৈরী প্রভাব বাধ্যতামূলকভাবে রিপোর্ট করার বিষয় আলোচনা করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে মতৈক্য এবং বিভিন্ন মত নিয়েই সম্মেলন শেষ হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বিশ্বের ৩০% এলাকা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য সংরক্ষণ করতে সম্মত হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধি দেশসমূহ প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল গঠনের পন্থা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি। অবশ্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তহবিল গঠনের উৎস হিসেবে ‘ডিজিটাল সিকোয়েন্স ইনফরমেশন (ডিএসআই)’ ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে কর প্রদানের  ব্যবস্থা গড়তে কলম্বিয়ার বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সম্মেলন একমত হয়েছে। বহুপক্ষীয় এই ব্যবস্থা গঠন ও কার্যকর করা হলে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুবীক্ষণিক জীব এর ‘জেনেটিক ইনফরমেশন’ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে (ঔষধ, প্রসাধন সামগ্রি ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক পণ্য উৎপাদনের জন্য) উৎসের দেশকে কর প্রদান করতে হবে। এতদিন জেনেটিক ইনফরমেশন ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও সমৃদ্ধ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের দেশ তা থেকে কোনো লভ্যাংশ পায়নি। এখন থেকে জেনেটিক ইনফরমেশন ব্যবহার করে বাণিজ্যের লাভের ১% লভ্যাংশ কোম্পানিগুলো জাতীয় সরকারকে স্বেচ্ছায় প্রদান করবে  বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় সরকারসমূহ নিজ দেশে এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ আইন ও বিধি প্রণয়ন করবে। আশা করা হচ্ছে, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বছরে এ খাত থেকে বড় তহবিল গঠন করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, বিশ্বের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বছরে অন্তত ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমান অর্থ প্রয়োজন। কোথা থেকে, কী ভাবে সে অর্থের সঙ্কুলান হবে সেটি উন্মুক্ত আলোচনার বিষয় এবং যতই দিন যাচ্ছে ধনী ও গরীব দেশগুলোর মাঝে তা নিয়ে বিরোধ এবং টানাপোড়েন বাড়ছে। কপ১৬ তার ব্যতিক্রম ছিল না। যতক্ষণ বিশ্ব পরিসরে সম্মিলিতভাবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত না নেওয়া হচ্ছে, আলাদাভাবে প্রতিটি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনে টেকসই, দূষণ নিয়ন্ত্রিত ও প্রকৃতিবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়ার আকাক্সক্ষা দূরবর্তীই থেকে যাবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × two =