জয়যাত্রা ও বাঙালির ঠিকানা

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই সময় ধারণ করে যেসব সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি সিনেমা ‘জয়যাত্রা’। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নিরীহ মানুষের অসহায়ত্ব, বেদনা ও ত্যাগের গল্প অসাধারণ ভাবে চিত্রিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রে। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে এখনো সমান ভাবে সহায়ক তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ সিনেমা। রঙবেরঙ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নিয়ে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে। মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদনে চলুন দেখে আসা যাক কেন মুক্তির ১৯ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক ‘জয়যাত্রা’।

মুক্তির আলোয় ‘জয়যাত্রা’
২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘জয়যাত্রা’ চলচ্চিত্রটি। প্রখ্যাত কাহিনিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাহিনি অবলম্বনে এ চলচ্চিত্রের সংলাপ, চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন তৌকীর আহমেদ। এটি তৌকির পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।

কী আছে ‘জয়যাত্রা’ সিনেমায়?
জয়যাত্রা স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। ১১৯ মিনিটের এই সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় দেশের একটি ছোট্ট সবুজ গ্রাম। রাজনীতি নিয়ে সে গ্রামের মানুষদের খুব বেশি আগ্রহ না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের সাথেও তাদের কোনো সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। সেই শান্ত গ্রামটিতেই এক রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। তাতে প্রাণ হারায় অনেকে। যারা বেঁচে যায়, তারা আশ্রয় নেয় এক নৌকায়। নিজের দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারত সীমান্ত লক্ষ্য করে চলতে শুরু করে নৌকা। এই মানুষগুলোর অসহায়ত্ব, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব এবং বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রমের গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘জয়যাত্রা’। চিলের মুরগির বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গ্রাম তছনছ করে দেওয়ার মতো রূপক ব্যবহার এ চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নানান চরিত্র এখানে উপস্থাপিত হয়েছে বিচিত্র রঙে। যুদ্ধ কিভাবে ধর্ম-বর্ণ সব বিভেদ ভুলিয়ে দেয় তার চমৎকার নিদর্শন রয়েছে এ চলচ্চিত্রে।

যাদের অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছে ‘জয়যাত্রা’
এ চলচ্চিত্রে হাওয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম আদম চরিত্রে, মাহফুজ আহমেদ ছিলেন বৈধন, হুমায়ুন ফরীদির চরিত্রের নাম ছিল পচা। তারিক আনাম খান ছিলেন তরফদার, আবুল হায়াতÑরামকৃষ্ণ, নাজমা আনোয়ারÑবৈধনের ঠাকুরমা, শামস সুমনÑজসিমুদ্দি, রুমানা খানÑসখিনা, শাহেদ শরীফ খানÑকাসেম, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনীÑমরিয়ম, ইন্তেখাব দিনারÑজনসন, আহসান হাবিব নাসিমÑমাঝি আলী, সালেহ আহমেদÑইমাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়Ñডা. কালিকিংকর, মোশাররফ করিমÑফনী, আহসানুল হক মিনুÑহামিদ, শিরিন আলম হামিদের স্ত্রী, অপূর্ব মজুমদার পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। তৌকীর আহমেদ ট্রাক ড্রাইভারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রত্যেক কলাকুশলীর অনবদ্য অভিনয়ে এক সুন্দর চলচ্চিত্র উপহার দিতে পেরেছিলেন তৌকীর। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রফিকুল বারী চৌধুরী। সম্পাদক ছিলেন অর্ঘকমল মিত্র। জয়যাত্রা ছবির ভিসিডি ও ডিভিডি বাজারজাত করেছে জি-সিরিজ।
পারিশ্রমিক পাননি জয়যাত্রার অভিনয়শিল্পীরা
সিনেমাটি নিয়ে গণমাধ্যমে নানা সময়ে কথা বলেছেন তৌকীর আহমেদ। আসলে অনেক মানুষের ভালোবাসায় নির্মিত হয়েছিল ‘জয়যাত্রা’। আর সবার প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন পরিচালক। তৌকীর আহমেদ এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আহমেদ, আজিজুল হাকিম, বিপাশা হায়াত, আহসান হাবিব নাসিম, ইন্তেখাব দিনার, চাঁদনীসহ আরও অনেকে; পুরো দলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ছবির বাজেট এত কম ছিল যে শিল্পীদের কোনো টাকা দিতে পারিনি। শুটিংয়ের আগে এ ব্যাপারে তাদের বলেও নিয়েছিলাম। তারা আমার কথা শুনে রাজি হন। বলতে পারেন, নিজ উদ্যোগে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করেছেন।

প্রি-প্রোডাকশনের ছয় মাস
খুব সহজ ছিল না এই সিনেমার প্রি প্রোডাকশনের কাজ। তৌকীর আহমেদের ভাষায়, ‘যতদূর মনে পড়ে, ছয় মাস লেগেছিল জয়যাত্রা ছবির প্রি-প্রোডাকশনের কাজ করতে। আমি যেহেতু স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র ছিলাম, নিজেই ছবি আঁকতাম। চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনাও করেছি; কিভাবে স্টোরিবোর্ড বানাতে হয়, স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়। আমি হাত পাকিয়েছি টেলিভিশন নাটক দিয়ে। কিছুক্ষণ ছবিটির নান্দনিক ভাবনার কাজ করছি, কিছুক্ষণ ব্যবস্থাপনার কাজ করছি। বাংলাদেশে সেই অর্থে নির্বাহী প্রযোজক থাকেন না বা প্রোডাকশন ডিজাইনার থাকেন না। তাই রাতে স্টোরিবোর্ড করছি, দিনে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর কার্যালয়ে দৌড়েছি। এভাবে ছয় মাসের মতো চলে গেল। প্রি-প্রোডাকশনে সময় দেওয়াতে কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেল।’

জয়যাত্রা সিনেমার শুটিং
পরিচালকের মুখ থেকে জয়যাত্রা সিনেমার শুটিংয়ের গল্প শুনলেও চমক লাগে। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। তৌকীর আহমেদের ভাষায় ‘জয়যাত্রা সিনেমায় ৬০ ভাগ শুটিং হয়েছিল বগুড়ার বাঙালি নদীতে। ছবিটি যারা দেখেছেন তারা একটি নৌকা দেখেছেন। নৌকার দৃশ্য ধারণ করতে আশপাশে সাতটা ট্রলার থাকত। বলা হয়, নৌকায় শুটিং সবচেয়ে কঠিন। কারণ নৌকা প্রতিমুহূর্তে তার অবস্থান পরিবর্তন করে। ঢেউয়ের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে নৌকার স্থান পরিবর্তন হয়। তার ওপর ভারী ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা! দৃশ্য ধারণের জন্য সাতটি ট্রলারের একটিতে থাকত ক্যামেরা। একটিতে জেনারেটর ও লাইট, আর একটিতে অভিনয়শিল্পীরা। যার যখন দৃশ্যধারণ ছিল, তখন তিনি নৌকায় উঠতেন। একটিতে চা-পানি, খাওয়া-দাওয়া। আরেকটিতে থাকত পুলিশ। শুটিংয়ের সময় পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষকে সামাল দিত তারা। কাজটি যদিও বেশ কঠিন ছিল। সাহস আর কমান্ডিং অ্যাবিলিটির কারণে উতরে যাই।’

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘জয়যাত্রা’র জয়জয়কার
২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় সিনেমাটি। তৌকির আহমেদ শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে পুরস্কার পান আমজাদ হোসেন। শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে পুরস্কার জিতে নেন সুজেয় শ্যাম, শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার পান মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের পুরস্কার জিতে নেন রফিকুল বারী চৌধুরী।

এক নজরে তৌকীর আহমেদ
মঞ্চ ও টেলিভিশনের অভিনেতা হিসেবে তিন দশকের অধিক সময় ধরে দর্শকের মন জয় করে আছেন তৌকীর আহমেদ। এক দশক ধরে তিনি নির্মাতা হিসেবেও মুন্সিয়ানা দেখিয়ে আসছেন। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি পেয়েছেন সাফল্য। সর্বশেষ ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমা দিয়ে তিনি রাঙিয়ে দিয়েছেন দর্শকের মন। তৌকীর আহমেদের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৫ মার্চ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

তৌকীর আহমেদের পরিবার
তৌকীর আহমেদ ১৯৯৯ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন নন্দিত মডেল, অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াতকে। সুখের সেই দাম্পত্য জীবন আলোকিত করে রেখেছে তাদের এক কন্যা আরিশা আহমেদ ও পুত্র আরীব আহমেদ। তার শ্বশুর কিংবদন্তি অভিনেতা আবুল হায়াত।

মঞ্চ থেকে শুরু
স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করলেও অভিনয় ও নির্মাণের স্বপ্ন ছিল তৌকীরের হৃদয়ে। নিজেকে তিনি ছাত্রাবস্থাতেই তৈরি করেছিলেন মঞ্চে। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন তিনি মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চ নাটক পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন এবং ২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমি থেকে চলচ্চিত্রে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।

অভিনেতা তৌকীর
তৌকীর আহমেদ আশির দশকের মাঝামাঝিতে বিটিভি’তে প্রচারিত নাটকে রোমান্টিক চরিত্রের শীর্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত স্বাধীনতাযুদ্ধ ভিত্তিক ‘নদীর নাম মধুমতী’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর তিনি আবুল হায়াত পরিচালিত প্রথম নাটক ‘হারজিত’-এ অভিনয় করেন। তার বিপরীতে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত। পরবর্তীতে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘চিত্রা নদীর পারে’ (১৯৯৯) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু অবলম্বনে নির্মিত ‘লালসালু’ (২০০১) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ
২০০০ সালের পর অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ২০০৪ সালে ‘জয়যাত্রা’ পরিচালনার মাধ্যমে। ২০০৬ সালে মুক্তি পায় তৌকীরের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় চলচ্চিত্র ‘রূপকথার গল্প’। চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ২০০৭ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’। রিয়াজ অভিনীত চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে প্রদত্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সাতটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। চলচ্চিত্রটি বালি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। দীর্ঘ আট বছর বিরতির পর ২০১৬ সালে মুক্তি পায় শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিম ও নিপুণকে নিয়ে তৌকীরের চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’। অবৈধ পথে বিদেশগামী মানুষের করুণ পরিণতির গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিটি দর্শক মহলে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটি কান উৎসবসহ দেশ-বিদেশের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়ে সুনাম অর্জন করেছে।

সর্বশেষ
এরপরের ছবি ‘হালদা’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৭ সালে। হালদা নদী আর তার আশেপাশের মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে ছবিটি। এর আগে তিনি তৈরি করেন ‘অজ্ঞাতনামা’। সর্বশেষ মুক্তি পায় তৌকীরের ‘ফাগুন হাওয়ায়’। বেশ প্রশংসিত হয়েছে ছবিটি। এখন নতুন সিনেমার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তৌকীর আহমেদ। দর্শক তার নতুন চমকের অপেক্ষায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

7 + 8 =