ঋষিকা
বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেন, পৃথিবী মানবতার। লিও টলস্টয় বলেছিলেন, জীবনের একমাত্র অর্থ মানবতার সেবা করা। আর বাংলার মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস বলেছিলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। অর্থাৎ মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম বলে মনে করে সেই বাণী সবাইকে বলে গেছেন বড় বড় ধর্মবোদ্ধা, সাহিত্যিক ও দার্শনিক। দালাই লামার মানবতার পৃথিবী তখনই সম্ভব হবে যখন মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব। আর মানবাধিকার রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মানবাধিকারহীন একটি দেশ কিংবা একটা পৃথিবী কল্পনা করা ভয়ংকর। মানবাধিকার শূন্য হওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরন ফিলিস্তিন। যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার দিনগুলোই যেন এক একটা বিশাল অভিশাপ।
মানবাধিকার দিবস
১৯৫০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১৭তম পূর্ণ অধিবেশনে ৪২৩ (৫) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সদস্যভুক্ত দেশসহ আগ্রহী সংস্থাগুলোকে দিনটি তাদের মতো করে উদযাপনের আহ্বান জানানো হয়। এর আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে দিবসটি উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘের নির্দেশনায় বিশ্বের সকল দেশে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নবরূপে সৃষ্ট জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ অর্জন। ঐতিহ্যগতভাবে ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার ক্ষেত্র পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকায় শার্পভিল গণহত্যাকে স্মরণ করে দিবসটি উদযাপিত হয় ২১ মার্চ।
দক্ষিণ আফ্রিকা ভিন্ন কেন
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ও সহিংস বিক্ষোভের ঘটনা শার্পভিল গণহত্যা। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে প্রায় বিশ হাজার কৃষ্ণাঙ্গের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় যা শার্পভিলে গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। শার্পভিল শহরে থানার বাইরে জড়ো হওয়া মানুষদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিনিগিংয়ের কাছে শার্পভিলের ব্ল্যাক টাউনশিপের এই ঘটনায় সেদিন পুলিশ ২৫০ জন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে হত্যা ও আহত করে। পুলিশের প্রকাশিত পরিসংখ্যানটিকে ভুল প্রমাণ করে পরবর্তীকালে দেখানো হয়েছে কমপক্ষে ৯১ জন নিহত এবং ২৩৮ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে। পুলিশ অনেক মানুষকে পালানোর সময় গুলি করে, ফলে কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যায়। যে এলাকায় গণহত্যা হয়েছিল এবং সেখানে নির্মিত স্মৃতিসৌধটি ২০২৪ সালের দিকে একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হয়ে ওঠে। যা নেলসন ম্যান্ডেলা লিগ্যাসি সাইট নামে পরিচিত।
মানবাধিকার রক্ষার গুরুত্ব
প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উপায় হলো তাদের মানবাধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সম্মান করা। মানবাধিকার হলো সমতা এবং ন্যায্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত নীতি। যে নীতি জীবন সম্পর্কে পছন্দ করার এবং মানুষ হিসেবে আমাদের সম্ভাবনা বিকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার সাধারণ সব অধিকার নিশ্চিত করাই মানবাধিকার। একটি শিশু অলিখিতভাবে তার মানবাধিকার নিয়েই জন্ম নেয়। তবে বিভিন্নভাবে তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আর এই লঙ্ঘন হতে পারে পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা বৈশ্বিকভাবেও। মানুষমাত্রই এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। যেকোনো বিবেচনায় প্রতিটি মানুষের বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। এই অধিকারে ব্যাঘাত ঘটলে বেঁচে থাকা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার অধিকারই মূলত মানবাধিকারের মূল অধিকার। আর মানুষের বেঁচে থাকাই যখন হুমকির মুখে পড়ে যাবে তখন মানবাধিকার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যেমন বিভিন্ন দেশের যুদ্ধকেই যদি আমরা ধরে নেই, যুদ্ধের কারণে অনেক মানুষ মারা যান। আর এই মৃত্যু কখনই স্বাভাবিক ও সাধারণ মৃত্যু নয়। আর সে জন্যই এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক বড় একটি উদাহরণ। মানবাধিকারের কথা মাথায় রেখে যেকোনো রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এই যুদ্ধ কিংবা হতাহতের ঘটনা কমে যাবে। তাই পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখার মূল কারণই মানবাধিকার রক্ষা করে চলা। শুধুমাত্র মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের নিশ্চয়তাই থামিয়ে দিতে পারে অনেক যুদ্ধ। পৃথিবীতে আসতে পারে শান্তি। এমনকি এ বিষয়টি বিবেচনায় নিলে জলবায়ু নিয়েও সমস্যার সমাধান চলে আসবে।
মানবাধিকার শিক্ষার গুরুত্ব
প্রত্যেকটি শিশু, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কর জন্য উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারের আন্দোলন সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ গ্রহণ করেছে। ১৯৯০ সালে শিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক অধিবেশনে সর্বশিক্ষা অভিযানের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশ সর্বশিক্ষা অভিযানের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ইউনেস্কো শিক্ষা সমন্বয়কারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাদেরকে আন্তর্জাতিক সমস্ত সুবিধা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, সামাজিক সংস্থা এবং সংবাদমাধ্যম প্রভৃতির সঙ্গেও ইউনেস্কো এ ব্যাপারে যোগাযোগ রেখে সর্বশিক্ষা অভিযানের মূল লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করে চলেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তার মধ্যে আরও বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় নিচু শ্রেণির মানুষ। মানুষকে মানুষ ভাবার শিক্ষা যতদিন না পর্যন্ত মানুষের মধ্যে আসবে ততদিন মানবাধিকার পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
যুদ্ধ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ
বর্তমানে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ফিলিস্তিনে চলছে। সেখানের মানুষের থাকার অধিকারকেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষ চিকিৎসা সেবাও পাচ্ছে না। বিশ্ব দরবারে এসব নিয়ে আলোচনা হলেও তার কোনো সমাধান দেখছে না বিশ্ব। ইসরায়েলি সেনারা ত্যক্ত-বিরক্ত এই যুদ্ধ করতে করতে। তবুও নেতাদের জেদ যেন থামছেই না। মৃত্যুর মিছিল দিন দিন বেড়েই চলছে। এই শোকের শেষ যেন নেই। এই সমস্যার কোনো সমাধান যেন নেই। এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় লিপ্ত। জাতিসংঘের একটি দেশ হয়েও রাশিয়া চালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ। জাতিসংঘও সেখানে যেন কোনো শক্ত অবস্থান নেওয়ার অধিকার হারিয়েছে। বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনের সময়ও বারবার হুশিয়ারি আসছিল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। এই নিপীড়ন বন্ধ না হলে তারা শক্ত অবস্থান নেবে। আর এই সব কিছুই হয় মানবাধিকার রক্ষার খাতিরে। একটা কথা আছে – জোর যার মুল্লুক তার। এই নিকৃষ্ট ক্ষমতার মোহ বা জেদ বা লোভ যদি কোনো ব্যক্তি, সমাজ, গোষ্ঠী বা দেশের পেয়ে বসে, সেখানে মানবাধিকার বলতে কিছুই থাকে না। তা লঙ্ঘিত হয়। যা এখন হরহামেশাই হচ্ছে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস