রোজা শেষ গ্রীষ্মের গ্যাস – বিদ্যুৎ চাহিদা কিভাবে মিটবে?

সালেক সুফী

সার, সিএনজি, শিল্পে গ্যাস রেশনিং করে কোনোভাবে রমজান মাস এবং সেচ চাহিদা মিটিয়েছে বিদ্যুৎ সেক্টর। ঢাকাকে আলোক উজ্জ্বল রাখতে ঢাকার বাইরের শহর এবং গ্রামাঞ্চলকে আঁধারে রেখেছে। বিশেষত রমজানের শেষ দিকে যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলো তখন কোথাও কোথাও ৮-১০ ঘন্টা লোড শেডিং হয়েছে। এখন ঈদের ছুটিতে চাহিদা অনেক কম থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু ১৫ এপ্রিলের পর থেকে সব কিছু চালু হলে একসময় দেশব্যাপী বিদ্যুৎ চাহিদা দৈনিক গড়ে ১৫,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। তখন দুটি এফএসআরইউ এক সংগে চালু রেখেও পেট্রোবাংলা বিদ্যুৎ সার, শিল্প কারখানা গুলোকে চাহিদা মত গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে না। ডলার টাকার সংকটে কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি কিনতে সংস্থাগুলো পারবে কীনা তা নিয়ে সংশয় আছে। তীব্র গরমের সময় ১,৫০০-২,০০০ মেগাওয়াট লোড শেডিং অনিবার্য হয়ে পড়বে।

কি কারণে, কেন, কাদের ব্যার্থতায় বর্তমান সংকট নতুন করে বলার নেই। ভুল পরিকল্পনা, ভ্রান্ত জ্বালানি ব্যাবস্থাপনা কৌশলের কারণে সৃষ্ট এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, আমলারা কারো কাছে কৈফৎ দিবে না বিশেষ আইনের কারণে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি এখন গ্রিড, নন গ্রিড মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭,০০০ মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু জ্বালানি সংকট এবং সঞ্চালন সীমাবদ্ধতার জন্য ১২,০০০-১৩,০০০ মেগাওয়াট চাহিদা পেরিয়ে গেলেই সংকটে পড়ছে বিদ্যুৎ খাত। সব সার কারখানা বন্ধ রেখে, সিএনজি, শিল্প কারখানায় গ্যাস রেশনিং করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ এবং সার কারখানাগুলোর কাছে বিপুল বকেয়া আছে পেট্রোবাংলা কোম্পানিগুলোর। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতের সরকারী কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হবার মুখে। নিজেদের কয়লা, নিজেদের গ্যাস সম্পদ মাটির নিচে রেখে সরকার কিছু সুযোগ সন্ধানী উপদেষ্টার পরামর্শে আমদানিকৃত জ্বালানি নির্ভর হওয়ার কারণে বর্তমান সংকট। অথচ সঠিক সময়ে খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কয়লা এবং গ্যাস উত্তোলন করে কাজে লাগালে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হত না।

এখন বৈষয়িক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের জ্বালানি সম্পদ উত্তোলন এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বাড়াতে হবে। বর্তমান আমলা নির্ভর জ্বালানি ব্যাবস্থাপনার পক্ষে জ্বালানী খাত উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব সন্দেহ আছে। প্রযুক্তিনির্ভর জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে প্রয়োজন দক্ষ আধুনিক জ্ঞান সম্পন্ন কারিগরী জনবল, প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।

সবচেয়ে বড় সংকট গ্যাস খাত নিয়ে। ২০০০-২০২৪ প্রকৃত পক্ষে ভুল কৌশলের কারণে জলে স্থলে গ্যাস অনুসন্ধান হয়নি বললে চলে।  চাহিদার দিকে দৃষ্টি রেখে উৎপাদন না বাড়ানোর ফলে প্রমাণিত গ্যাস সম্পদ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে আসছে। মুখে অনেক কিছু বলা হলেও বাপেক্সকে সত্যিকার অর্থে কারিগরি এবং আর্থিক ভাবে সক্ষম করা হয়নি। দেশের প্রয়োজনে স্থলভাগ এবং সাগরে অনুসন্ধান হয়নি। অনেকের দাবি কিছু ব্যাবসায়ী মহলকে অযাচিত সুবিধা দেয়ার জন্য বিদেশ থেকে এলএনজি, কয়লা আমদানির ঝুঁকি নেয়া হয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব বাজার থেকে উঁচু মূল্যে জ্বালানি ক্রয় বাংলাদেশের সক্ষমতার বাইরে চলে গাছে। সরকারের উপদেষ্টা মন্ত্রীদের কার্যক্রমে মনে হয় সরকার সংকট বজায় রেখে কিছু মহলকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। জ্বালানী আমদানির অবকাঠামো পর্যাপ্ত পরিমানে গড়ে উঠেনি। বর্তমানে দুটি ভাসমান টার্মিনাল দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০০-১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার সুযোগ আছে। দুটি টার্মিনাল একসঙ্গে চালু থাকলে এবং এর সঙ্গে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর সর্বোচ্চ ২,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ করে সর্বোচ্চ ৩,০০০-৩,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব। কিন্তু এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ চাহিদা ৪২০০-৪৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।  তাই অন্তত ২০২৬ পর্যন্ত দৈনিক ১২০০-১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি থাকবে। ফলশ্রুতিতে গ্রীষ্মে ২০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোড শেডিং হতে পারে। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট থাকবে। মে মাস থেকে সেচ চাহিদা থাকবে না। সরকারকে বিদ্যুৎ ব্যাবহারে কৃচ্ছতা অবলম্বন করতে হবে। চুরি, অপব্যাবহার রোধ করতে হবে, লাইটিং, কুলিং লোড সীমিত করতে হবে। গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটকে জাতীয় সংকট বিবেচনা করে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে।

শোনা যাচ্ছে আজ বা কাল থেকে সামিটের ভাসমান টার্মিনাল পুনরায় চালু হবে। সেই ক্ষেত্রে গ্যাস গ্রিডের চাহিদা সমন্বয় করে ১৫ এপ্রিল পরবর্তী গ্যাস চাহিদা সমন্বয় করার পরামর্শ দিচ্ছি। প্রয়োজনে দোকান মালিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিকেল তিনটা থেকে রাত দশটা শপিং ব্যবস্থা পুনঃবিন্যাস করা যেতে পারে। তাহলে দিনের পিক চাহিদার সময় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্ষমতা সংরক্ষিত রেখে সান্ধ্য পিক সামাল দেয়া সহজ হবে।

দেশবাসীকে বিদ্যুৎ গ্যাসের সঠিক ব্যবহার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে রুফটপ সোলার অবদান দ্রুত বাড়ানোর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

 

সালেক সূফি, জ্বালানি খাত বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 20 =